গ্রীষ্মের ছুটিতে ট্রেনে করে লন্ডন যাচ্ছি। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে যাত্রা করে থামতে হবে লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে গিয়ে। লম্বা জার্নি। দুদিন ও তিন রাতের এ যাত্রায় লিথুনিয়া, বেলারুশ, পোল্যান্ড, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি পেরিয়ে নামতে হবে নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড বন্দরে। ওখান হতে রাতের ফেরী ধরে পাড়ি দিতে হবে ইংলিশ চ্যানেল। চ্যানেলের ওপারে হারউইচ বন্দর। এবং ওখানেই দেখা মিলবে প্রাক্তন প্রভু ব্রিটিশদের। বছরের এ সময়টায় মস্কোস্থ বৃটিশ দূতাবাসে অস্বাভাবিক রকমের ভীড় থাকে। ভিসার জন্য রাতের অন্ধকারে লাইন ধরতে হয়। বসন্তকাল হলেও সকালের দিকের তাপমাত্রা প্রায়শই হিমাংকের নীচে নেমে যায়। তাই বাধ্য হয়ে কেউ একজন কলম্বাসের কায়দায় আবিস্কার করল ইংলিশ ভিসার নতুন রুট। পূর্ব জার্মানীর রাজধানী পূর্ব বার্লিন।
পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে প্রথম ট্রানজিট। ট্রেন বদল করে ধরতে হবে বার্লিন গামী লোকাল একটা ট্রেন।কাউন্টারে গিয়ে টিকেট মাষ্টারের চেহারা দেখে ভড়কে গেলাম। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় টিকেট কাউন্টারে গোস্বা মুখ মানেই খেলা ফাইনাল! মহিলা জানাল কেবল আজকেই নয়, আগামী সাতদিনের জন্য বার্লিন গামী ট্রেনের কোন সিট নেই। সকাল ৯টায় আমাকে বার্লিনস্থ ইংলিশ দূতাবাসে হাজির থাকতে হবে। দুপুর ১টায় ধরতে হবে নেদারল্যান্ডগামী ট্রেন। চোখে মুখে অন্ধকার দেখলাম। ওয়ারশতে এসেছি ২৪ ঘন্টার ট্রানজিট ভিসায়। থাকার উপায় নেই। প্লাটফর্মের উপর বিক্ষিপ্তভাবে হাঁটছি আর অংক কষছি। কোন সমাধানই মাথায় ঢুকছে না। ভেতরে এক ধরণের অস্থিরতা চাপতে শুরু করেছে। হঠাৎ করেই দেখা গিনি বিসাউ'র বন্ধু আলবার্টের। সে সিট কনফার্ম করে অপেক্ষা করছে ট্রেনের। আমার অবস্থা খুলে বলতে হো হো করে হেসে উঠল। অদ্ভুত একটা সমাধান দিল। বুক পকেটে পাচ ডলারের একটা নোট এমনভাবে রাখতে হবে যেন কাউন্টারের বসা মহিলার নজরে আসে। গুড লাক বলে এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠল। যেমন কথা তেমন কাজ। পকেটে পাচ ডলারের নোট ঝুলিয়ে অনেকটা চোরের মত আধা ঘন্টার ভেতর আবার হাজির হলাম মহিলার সামনে।
- কি চাই তোমার?
- বার্লিন গামী ট্রেনের একটা সিট।
- কখন যেতে যাও?
- আধাঘন্টা পরে যে ট্রেনটা আসছে সেটায়।
- পনের মিনিট পরও একটা ট্রেন আছে। ওটা গদানস্ক হতে আসছে।
- তাহলে আরও ভাল হয়।
- তোমার পকেটে ওটা কি?
- যা দেখছ তাই। তবে ওটা তোমার জন্য।
- ওটা দ্বিগুন করে তোমার ফিরতি সিট কনফার্ম করারও সুযোগ আছে।
- থ্যাকংস্। ফিরতি পথে আমি ওয়ারশতে থামছি না। সোজা চলে যাব বেলাওস্তকে।
সিট কনফার্মের সাথে এক টুকরা কাগজ দেখে অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করতে ফিসফিস করে জানাল কখনো যদি ওয়ারশতে রাত কাটানোর প্রয়োজন হয় যেন ফোন করি। নিজে এসে নিয়ে যাবে।
সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের চৌদ্দগুষ্টি নতুন করে উদ্ধার করে চেপে বসলাম বার্লিন গামী এক্সপ্রেস ট্রেনটায়।
(সময় ১৯৮৪ সালের বসন্তকাল)।