ক্রিকেট বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহটা সেদিনই হারিয়ে ফেলেছি যেদিন শুনেছি একজন চলমান খেলোয়াড় এবং দলের ক্যাপ্টেন সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তাও আবার যেনতেন নির্বাচন নয়, রাতের অন্ধকারে ভোটবাক্স ভর্তি করার স্টেইট স্পন্সরনড জালিয়াতির নির্বাচন। একই দলের আরও একজন খেলোয়ড় এই তালিকায় নাম লেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আলীবাবা চল্লিশ চোর দলের মূল চোর নিষধ করায় তিনি এ যাত্রায় সাইডলাইনে বসে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য আমার মত একজন লো-প্রোফাইল নাগরিকের আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় ক্রিকেটের তেমন কিছু আসে-যায় তা নয়। যেহেতু খেলাটা বুঝি এবং ভালবাসি তাই একেবারে ইগ্নোর করার মত মনমানষিকতা এখনো গ্রো করতে পারিনি। ফাঁকে ফাঁকে এখনো বাংলাদেশ ক্রিকেট টীমের রোলারকোস্টার রাইড দূর হতে ফলোকরি। দল জিতলে খুশী হই, হারলে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আফগানিস্তানের সাথে টেস্ট খেলায় বাংলাদেশ হারবে এমন উপসংহারে আসতে খুব একটা অপেক্ষা করতে হয়নি আমার। প্রথমদিনের শেষেই তা বুঝে নিয়েছি।
সন্দেহ নেই বাংলাদেশ দলের সমর্থকের সংখ্যা কয়েক কোটি। প্রতিটা জয় পরাজয়েই এরা সবাই আন্দেলিত হয়ে নিজেদের উচ্ছাস অথবা হতাশা ব্যক্ত করে থাকে। সোস্যাল মিডিয়ার কারনে এসব আমরা প্রবাসীরাও টেরপাই। আফগানিস্তানের সাথে এবারের হার সমর্থকরা সহজে মেনে নিতে পারছেনা। অনেকে অনেকভাবে তা প্রকাশ করছে। অনেকে কারণ তুলে ধরছে। অনেকে আবার অমুক খেলোয়াড়কে সরিয়ে তমুক খেলোয়াড়কে দলে নিলে জয় নিশ্চিত ছিল এমন ধারণাও দিতেও দেরী করছে না। কোচ, বোর্ড কর্মকর্তাদের ধোলাই এখন ডাল-ভাত। সবই ঠিক আছে। কিন্তু তাতে খেলার মান বাড়ার কোন প্লাটফর্ম তৈরী হচ্ছে তা কিন্তু নয়। বরং আমার মত অনেকের কাছে বাংলাদেশের বাকি অনেক কিছুর মত ক্রিকেটেও বিতৃষ্ণা বাড়ছে।
এবারের হারে আমার নিজেরও একটা বিশ্লষণ আছে, যা অন্য কারও বিশ্লেষণের সাথে মিলবে বলে মনহয় না। আফগানিস্তানের সাথে বাংলাদেশ যা খেলেছে আমার মতে এটাই বাংলাদেশের আসল খেলা। এটাই তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ উচ্চতা। মাঝে মধ্যে এদিক সেদিক হলেও এপথেই এগুবে বাংলাদেশের ক্রিকেট। একসময় বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে আমরা মাতামাতি করেছে। আবাহনী মোহামাডান খেলাকে জাতীয় উৎসবে অথবা শোকে পরিনত করতে অভ্যস্ত হয়েছি। কিন্তু যেদিন ক্যবল টিভির বদৌলতে আমরা বাইরের খেলা দেখতে শুরু করেছি খুব দ্রুতই বুঝে গিয়েছি বাংলাদেশের ফুটবলের মান ও আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় এর অবস্থান। আমরা তাই সহজেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি ফুটবাল নামের এ তামাশা হতে। ফুটবলের মত ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় কোন খেলা নয়। এ খেলা সীমাবদ্ব মূলত বৃটেন ও তার প্রাক্তন কলোনিয়াল সাম্রাজ্যে। আরও সংক্ষেপে বললে এ খেলার মূল দর্শক আসলে আমাদের উপমহাদেশ। উপমাদেশের দর্শকদের কাছে এ খেলা অন্যদের মত অবসরের বিনোদন নয়, বরং আসক্ত নেশা।
শারীরিক গঠন, মানষিক উন্নয়ন, ডেডিকেশন, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, সবকিছুর সমন্বয়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা যা খেলছে তাতে ক্ষোভ প্রকাশ করার কোন হেতু আছে বলে আমি মনে করিনা। কারণ ক্রিকেট কোন বিচ্ছিন্ন ইভেন্ট নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বিক চিত্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট জগতকে ক্ষুদ্র পরিসরে রাজনীতির মাঠ হিসাবে নিলে সমীরকরণটা সহজ হয়ে যাবে। একটা গড়পরতা উচ্চতায় উঠার পর বাংলাদেশের জাতীয় দলের প্রতিটা ক্রিকেট খেলোয়াড় নিজেদের একজন রাজনীতিবিদের আসনে বসিয়ে ফেলেন। রাজনীতিবিদরা যেমন জনসেবা ফেলে চুরির মহোৎসবে মেতে উঠেন, তেমনি ক্রিকেট খেলোয়াড়রাও নিজেরদের আসল কাজ ক্রিকেট ফেলে মেতে উঠে নিজেদের এক্সপোজারে। এই এক্সপোজার তাদের এনে দেয় খ্যাতি, অর্থ, নারী, বাড়ি, গাড়ি সহ আরও অনেককিছু। মাঠে অতিরিক্ত একটা চার মারলে পরদিন সংবাদের শিরোনাম হয়ে থাকবে তার কীর্তি, এমনটা মাথায় রেখেই মাঠে নামে কথিত তারকা খেলোয়াড়রা। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে কার্পন্য করেনা। তবে সে চেষ্টা দলের জন্য নয়, বরং নিজের জন্যে। মার্কেট ভ্যলু বাড়ানোর জন্যে। বাকি জনগোষ্টির মত ক্রিকেটাররাও দৌড়াতে শুরু করে ভাগ্যের পিছনে। আমরা যদি আমাদের চেহারাটা ভাল করে আয়নার দেখার চেষ্টাকরি তাহলে ক্রিকেটারদের উত্থাণ পতনের সমীকরণটা মেলাতে সহজ হবে। দিন শেষে ওরাও বাংলাদেশি।
জাতির সার্বিক চরিত্রের সাথে ক্রিকেট চরিত্রের মিল থাকবেনা এমনটা ভাবা অন্যায়। তাই আফগানদের সাথে টেস্ট খেলায় যা ঘটেছে তা নিয়ে হা হুতাশ করার কোন কারণ দেখিনা। এটাই বাংলাদেশের ক্রিকেট। এবং এটাই বাংলাদেশ।