গোটা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টকে ঢেলে সাজিয়েছে আমার কোম্পানী। ১২ জনের টীমকে ছেটে ২ জনে নামিয়ে এনেছে। গত ৬ মাস ধরে চলেছে এই নিধন পর্ব। শুক্রবার হলেই আতংকে থাকতো সবাই। এইবুঝি সমন এলো! হাতে ঘণ্টা খানেকের সময় দিয়ে বলতো, নিজের যা আছে গুছিয়ে সীমানার বাইরে যাও। অফিস সিকিউরিটি এসকোর্ট করে এগিয়ে দিতো মূল ফটকের কাছে। এবং ওখানেই শেষ হতো অনেকের প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের এই পর্ব ৪৫ বছর চাকরির পর এ ধরণের পুরস্কার অনেকের কাছে ছিল হ্রদয়বিদারক। মানষিকভাবে আমিও প্রস্তুত ছিলাম। কোম্পানীর চাকরিতে আমার বয়স ১৩ বছর। সেই ২০০৭ সালে নিউ ইয়র্ক হতে উড়ে এসেছিলাম অনিশ্চয়তার পথ পাড়ি দিতে। টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারিং'এটা ছিল আমার প্রথম ভেঞ্চার। অনেক কিছু শেখার বাকি ছিল। দিনের পর দিন আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমের তাতানো গরমে চষে বেড়িয়েছি অঙ্গরাজ্যের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তে। প্রথম পাচঁ বছর চুক্তিবদ্ধ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। ২০১২ সালে স্থায়ী হতে কোম্পানী নিজেই অফার করেছিল। প্রস্তাব লুফে নিয়ে আগপিছ না ভেবে ঝাঁপিয়ে পরি নিজ কাজে। তারপর একে একে কেটে গেছে আরও ৮ বছর। পৃথবীজুড়ে কোম্পানীর ৪৪ হাজার এমপ্লোয়ির একজন হয়ে মিশে যাই মূল্ধারায়।
আমেরিকার কর্পোরেট জীবন অন্যরকম। সবকিছুতে তীব্র প্রতিযোগীতা। কেবল যোগ্যারাই টিকে থাকে এ দৌড়ে। কোন এক সুন্দর সকালে ঘোষণা আসে বিক্রি হয়ে গেছে আমাদের কোম্পানী। একই লাইনের অন্য এক কোম্পানী কিনে নিয়েছে আমাদের। শুরু হয় পরিবর্তন। যার শুরু ছাঁটাই দিয়ে। অনিশ্চয়তার তীব্র দাহ গ্রাস করে নেয় সবাইকে। অনেকে স্বইচ্ছায় সরে যায়। শুরুটা একজন আদীবাসি আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে। জেমসকে ডেকে আনাহয় মাঠ হতে। সময় দেয়া হয় এক ঘণ্টা। ওর চোখে পানি দেখে আমি বিস্ময়ে অবাক। জিজ্ঞেস করতেই বললো চাকরি এখানেই শেষ। একে একে অনেকেই বিদায় নেয়। আমি কেবল দিনগুনি আর মনে মনে পরিকল্পনা করি পরবর্তী চাকরির।
যেদিন আমার বসের চাকরিটা গেল ভেতরের আশংকা কেন জানি উবে যায়। সে ছিল ডিপার্ট্মেন্টের ম্যানেজার। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমাকে বিদায় জানাতে এলে তার চোখও লাল দেখেছিলাম। এক মাস পর বিদায় হয় বসের বস, ডিপার্ট্মেন্টের ডিরেক্টর। এর দু'সপ্তাহ পর ডিরেক্টরের বস ভাইস প্রেসিডেন্ট। এবং সব শেষে তারও বস। মানে কোম্পানীর সর্বোচ্চ ব্যক্তি, চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও)। আমি ধরেই নিয়েছিলাম ঘণ্টা বাজা আমার জন্যে সময়ের ব্যপার মাত্র।
এমপ্লোয়িদের কঁচুকাটার পর আমাদের ডিপার্ট্মেন্টে আমরা দুজন টিকে যাই। গোটা কোম্পানীকে ঢেলে সাজায় নতুন প্রশাসন। শেয়ার হোল্ডারদের খুশি করতে গিয়ে এমন অনেক সিদ্বান্ত নেয় যা ছিল আমাদের স্বার্থ বিরোধী। ম্যানেজমেন্টের একটাই ভাষ্য, take it, or leave it.
অনেকদিন পর কাজ উপলক্ষের বাইরে বের হয়েছিলাম গতকাল। বেলেন বলে একটা ছোট শহর আছে এখানে। আছে একটা ছোট এয়ারপোর্ট। ফেডারেল এভিয়েশন এডমিন কি সব ষ্ট্রাটেজিক স্থাপনা বসাচ্ছে যা নিয়ে কথা বলার অধিকার বন্ধ করা হয়েছে Non Disclosure Agreement'এ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে। ফ্রীওয়ে ধরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ড্রাইভ করলে ৩০ মিনিটের জার্নি। এ পথে ড্রাইভ করলে মন এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। উপর নীল আকাশ, পাশে পাহাড়, যতদূর চোখ যায় খোলা মাঠ আর মাঠে। জনমানবের চিহ্ন নেই কোথাও। এরকম ড্রাইভে বের হলে আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমের প্রেমে না পরার উপায় নেই। ইদানিং কাজে আর বাইরে বেরোতে হয়না। গোটা দশেক কন্ট্রাক্ট ইঞ্জিনিয়ার আমার হয়ে কাজটা করে যাচ্ছে।
ফ্রীওয়ে হতে বের হতেই চোখে পরল রাস্তাটা। অদ্ভুত নাম...দেশি লুপ! এ অঙ্গরাজ্যে আদিবাসী আমেরিকানদের একটা ট্রাইব আছে যার নাম জিয়া পুয়েবলো।