সময়টা ছিল জীবনের সোনালী সময়। আমি ব্যাচেলর। চাইলে যে কারও দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি। সম্পর্কে জড়াতে চাইলে সেটাও কোন অন্যায় হবেনা। বিয়ে তো পরের কথা। এক কথায় আমার জগতে আমি এলিজিবল ব্যাচেলর। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর এক্সেকিউটিভ ডিরেক্টটর। অফিস মোহম্মদপুর, থাকি পুরানা পল্টনে। প্রতিদিন রিক্সায় চড়ে অফিসে আসি। উপভোগ করি ঢাকার নিঃশ্বাস। একজন ব্যাচেলরের জন্য এর চাইতে ভাল কিছু আশাকরা অন্যায় হবে।
অফিসে দাড়োয়ান এসে জানাল কেউ একজন আমার সাথে দেখা করতে চাইছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, অনেকেই দেখা করতে আসে। তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। আসতে বললাম। তবে এ যাত্রায় যে আসলো তাকে দেখে অবাক হলাম। একজন তরুনী। একজন পুরুষের যে কোন মানদন্ডে সুন্দরী। বয়স ১৮/১৯'এর বেশি হবেনা। নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলো একটা ফোন করতে পারবে কিনা। না করতে পারলাম না। ভুলটা এখানেই করে বসলাম।
ফোন করার ধারাবাহিকতা চলে থাকলো। অনেক সময় দিনে একাধিবার। যহেতু সামনে বসেই কথা বলে, আলাপচারিতার সারমর্ম উদ্ধার কষ্ট হলনা। কি নিয়ে যেন বিভিন্ন জনের সাথে দেন দরবার করছে। একসময় নিজেই জানালো, টিভির তালিকাবদ্ধ একট্রেস সে। আপাতত হাতে তেমন কাজ নেই, তাই বিপনন বিজ্ঞাপনের মডেলিং করছে। দু'একটা বিজ্ঞাপনের রেফারেন্স দিল এবং টিভিতে যাচাই করে এর সত্যতা পেলাম।
শুরুটা এভাবেই।
শ্রাবনের বৃষ্টিভেজা এক দুপুরে ভেজা শরীরে অফিসে হাজির। বাসা একই রাস্তায় কয়েক ব্লক দূরে। তার মা আমার সাথে কথা বলতে চাইছ। কারণ আমাদের দুজনকে নিয়ে ইতিমধ্যে পাড়ায় গসিপ শুরু হয়েছে। নিজকে পরিস্কার করাটা জরুরি ছিল। তাই দু'বার চিন্তা না করে পিছু নিলাম।
অবাক হলাম, গোটা বাসা অন্ধকার। ড্রইং রুম বলতে কিছু নেই। সরাসরি বেডরুমে নিয়ে গেল। ওখানেই দেখা মা'র সাথে। খাটে শুয়ে আছে অসূস্থ বাবা। পরিচয় পর্ব শেষ হতে অদ্ভূত একটা প্রস্তাব করল। বাসায় একটা রুম খালি, ওটা সাবলেট নিলে ওদের উপকার হবে। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে প্রতিদিন আমি বহুদূর হতে রিক্সা করে অফিসে আসি। ভো করে উঠল মাথা! পৃথিবীর ঘাঁটে ঘাঁটে পোড় খাওয়া মানুষ আমি, অনেক দিক হতে অনেকের চাইতে ম্যাচ্যুরড। সাবলেট থাকার প্রস্তাব সহজভাবে নিলাম না। সাথে সাথে না করে দিলাম। এ ধরণের পরিবেশে থাকার প্রশ্নই আসেনা। এর পরই থেমে গেল অফিসে ফোন করার পর্ব।
দু;মাস গ্যাপ দিয়ে আবারও হাজির। এবার আর ফোন নয়, আমার সাথে কথা বলার উদ্দেশ্য নিয়ে। অফিসে বসে সদ্য পরিচিত একজন সুন্দরীর সাথে আলাপ ছিল আমার মেনুর বাইরে। সরাসরিই তাকে বলে দিলাম। মনখারাপ করল। বিশেষ কথা আছে বলায় বাইরে কোথাও দেখা করার প্রস্তাব করলাম। রাজী হল। এবং যে কোনদিন অফিসের পর আমাকে নিতে আসবে।
অফিস হতে বাসায় ফিরতে প্রায়ই রাত হয়ে যেতো। এবং সে তা লক্ষ্য করেছিল। রোজার মাসের কোন এক সন্ধায় দুজন রিক্সায় চেপে বসলাম। আমার শর্ত; রিক্সায় বসলে তার হুড বন্ধ করা চলবেনা। কোন মেয়ের সাথে আমি রিক্সায় ঘুরছি, আমার পরিবার বাকি সবার জন্যে এক অর্থে এটা হতো খুশির খবর। কারণ অনেকদিন ধরেই সবাই চাচ্ছিলো কারও সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠুক।
রিক্সায় উঠে রাখডাক না করে সরাসরি বলে ফেললো। দুদিন পর ঈদ। বাসায় বাবার অসুখ। আয় রোজগার বলতে তেমন কিছু নেই। আমাকে ধার দিতে হবে। আমিও খোলামেলা জানিয়ে দিলাম, আমি কাউকে ধার দেইনা। কারণ ধারের টাকা ফেরত যাওয়ার যে গুনাবলি তা আমার নেই। প্রস্তাব করলাম, সামনে আড়ং, বরং ওখানে শপিং করলে সবটাই আমি পে করবো। এবং তা ফেরত দেয়ার প্রশ্ন থাকবেনা। খুব খুশী দেখালো তাকে। এবং দুজনেই ফুরফুরে মেজাজে ঢুকে পরলাম আড়ং'এ।
আর্থিক সামর্থ নিয়ে আমার কোন সমস্যা ছিলনা। সেটা বুঝতে পেরে সে এলাহি কেনাকাটি করে ফেললো। এবং তা নিজের সহ বাসার সবার জন্যে। কেনাকাটির সবটা দ্রুত বাসায় রেখে ঘুরতে বের হলাম আমরা।
ততক্ষণে রাত ৯টা বেজে গেছে। জোৎস্নার প্লাবন বইছে ঢাকা শহরে। পাশেই সংসদ ভবন। কোনদিন যাওয়া হয়নি। অনেকেই যায় এবং ফিরে এসে গল্প করে। সুন্দর একটা নীল রংয়ের জর্জেট শাড়িতে চমৎকার দেখাচ্ছিলো তাকে। দুজনের মনেই সুখের নহর বইছিলো যেন। রিক্সা ছেড়ে হাটতে শুরু করেছি কেবল। দু'দিক হতে দু'জন পুলিশ এসে ঘেরাও করলো আমাদের।
'ভাইজান, আপ্নে ধরা খাইসেন' - ৩০৩ রাইফেল হাতে দুজন মোজাফর সামনে আসলো
একটু থতমত খেলাম। ধরা খাইসি বলতে কি বুঝাতে চাইছে বুঝতে পারলাম না। কিছুটা সময় লাগলো হুশ ফিরে পেতে।
'ধরা খাইলে এমুন কথা সবাই কয়' - ইতিমধ্যে তৃতীয় মোজাফর হাজির হয়েছে ঘটনাস্থলে।
কিছুটা সময় লাগলো ব্যপারটা বুঝতে। পুলিশি অভিযোগের সারমর্ম হচ্ছে, আমি রাস্তার ভাসমান পতিতা নিয়ে এখানে হাওয়া খেতে এসেছি।
এবার আমার পালা কথা বলার।
প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলাম তাদের অভিযোগের। আমার সাথে্র জন পতিতা কিনা বা পতিতা হলেও তাদের অসুবিধাটা কোথায় তার ব্যখ্যা চাইলাম। তারা এত কথা শুনতে রাজী ছিলনা। হিসাব সোজা, রাতে এ অঞ্চলে যারা ঘুরতে আসে তারা সবাই পতিতা ও তাদের খদ্দের। এতরাতে ভদ্রঘরের কোন মেয়ে ঘুরতে বের হয়না। রাত ৯টায় ঘুরতে বের হওয়া দেশের কোন আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তার রেফারেন্স চাইলাম। আলাপচারিতা উত্তেজনার পর্যায়ে চলে গেল। আমার সাথের জন থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো।
সিনিয়র লেভের একজন মোজাফর যোগ দিল তর্কে। কিছুক্ষণ বেহুদা তর্ক করে ফিরে গেল নিজ চৌকিতে। আরও একজন ফলো-আপ করতে যোগ দিল। মিমাংসা; টাকা দিতে হবে তাদের। এবং তা দিলে আমাদের বিনা বাধায় যেতে দিতে। না দিলে থানায় নিয়ে যাবে এবং পরিবারকে অবহিত করবে। এতক্ষনে আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে স্বস্তি পেলাম।
কাজী জাফর তখন সরকারের প্রধানমন্ত্রী। আমার ও আমাদের পরিবারের লাইফ লং ওয়েল উইশার। তিনি যখন মাওলানা ভাসানির রাজনীতি করেন তখন হতে পরিচয়। মন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে সাপ্তহিক
হক কথা' অফিসে মাঝে মধ্যে কথা হতো। ছোট ভাইয়ের মত জানতেন আমায়। সরকারে যোগ দেয়ার পর জাফর ভাইয়ের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। হঠাৎ করেই সম্ভাবনাটা মাথায় ঢুকলো।
ঠোলাদের বসকে আসতে বললাম। দফারফা যা হওয়ার তার সাথেই হবে। তিনি এলেন এবং হাতে আমার একটা বিজনেস কার্ড ধরিয়ে মনযোগ দিয়ে আমার কথা শুনতে বললাম। সময় দিলাম ৫ মিনিট। এর মধ্যে আমাদের স্বসন্মানে ছেড়ে না দিলে কার সাথে যোগযোগ করবো তার তালিকা দিলাম। পূর্তমন্ত্রী জামাল হায়দার ভাই আমার ছোটকালের মেন্টর। তারও নাম দিলাম। এবার শুরু হলো রিভার্স একশ্যান। নাটের গুরু বাকি ঠোলাদের ডেকে ধমকাতে শুরু করলো। ভুল হয়েছে তাই সবার হয়ে ক্ষমা চাইলো। একটা রিক্সা ডেকে আমাদের দুজনকে তুলে দিল।
রাত তখন প্রায় ১১টা। মাথার উপর রূপালী চাঁদ। জোতস্নার প্লাবন বইছে ঢাকার আকাশে বাতাসে। যে রাতটা হতে পারতো রোমান্টিকতার রাত সে রাতেই অভিজ্ঞতা হলো দেশীয় বিভিষিকার সাথে।
দুজনের কারও মুখে কোন কথা ছিলনা। বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়ছিলো তার। এসব কোন কিছুই আমাকে আন্দেলিত করছিল না। আমি শুধু রিক্সাওয়ালার প্যাডেল চাপানো দেখছিলাম। এই প্রথম একটা দেশের নাগরিক হওয়ায় নিজকে অপরাধী মনে হলো। কোন শব্দ না করে তাকে বাসার পাশে নামিয়ে দিলাম। এবং এটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা।