কিছু কিছু স্মৃতি সহজে মলিন হয়না। কিছু ঘটনা অবাক করা হলেও স্থায়ী হয়ে যায় মনের গহীনে। তেমনি এক ঘটনা। করোনা তখনও দূরের দেশ চীনের গল্প। আর দশটা উইকএন্ডের মতে সেদিনও পরিবারের সবাইকে নিয়ে দোকানে গেছি। কেনাকাটি সেরে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি কেবল। গিন্নীর হা হা করে উঠল; প্রয়োজনীয় কিছু একটা কেনা হয়নি। বিরক্ত হয়ে দোকানে ফিরে যাওয়ার অনীহা প্রকাশ করলাম। ওরা গেল, আমি গাড়িতে বসে পার্কি লটে ওদের অপেক্ষায় রইলাম…
মধ্যবয়সী চমৎকার শরীরের এক ভদ্রমহিলা এদিক ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। কথা বলতে ইতস্তত করছেন… – তোমাকে একা কথা না বললেই নয়। অভয় দিলে বলতে পারি। – শোনায় আমার কোন আপত্তি নেই তা যদি হয় সংক্ষিপ্ত। আবারও এদিক ওদিক তাকালো। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে শুরু করল কথা। – আমাকে কি কয়েকটা ডলার দিতে পারবে? খুব দরকার ছিল। প্রয়োজনটা বলতে অস্বস্থি লাগছে। দিলে দাও, না দিলে এখুনি চলে যাবো। একটু অবাক হলাম তার তাড়া দেখে।
এদেশে অনেকে অনেক কায়দায় ভিক্ষা চায়। প্রয়োজনটা ঘুরে ফিরে এক জায়গায় এসে থেমে যায়…রাস্তায় আটকে গেছি। গাড়িতে তেল নেই। সাহায্য করলে তেল কিনে ঘরে ফিরতে পারবো। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব কাহিনী মিথ্যা। মূল প্রয়োজন, ড্রাগ কেনার অর্থ যোগান।
পার্কিং লটে ভিক্ষুকদের ভিক্ষার সাথে আমি অপরিচিত নই। এর আগেও মুখোমুখি হয়েছি এবং সব ক্ষেত্রে নিজের অপরাগতার কথা জানিয়ে ক্ষমা চেয়েছি। এ যাত্রায় মহিলার চেহারা ও গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যা সহজে এড়ানোর মত ছিলনা। – তোমার প্রয়োজনটা শোনার মত আমার হাতে কয়েক মিনিট সময় আছে। বলে ফেল। – আমার ব্রেষ্ট ইমপ্লান্ট করাতে হবে। অনেক অর্থের প্রয়োজন। ঘরে যা আছে তা যথেষ্ট নয়।
– তোমার ব্রেষ্ট ইমপ্লান্টের জন্যে আমি ডলার দেব, এমনটা কেমন করে ভাবলে? এতো জরুরি কিছু নয়। বরং কসমেটিক কিছু। – না, আমার জন্যে খুব জরুরি। আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে অন্য এক মহিলার পিছু নিয়েছে। মুখোমুখি হতে জানাল, আমার ব্রেষ্ট নাকি তাকে ধরা রাখার জন্যে যথেষ্ট নয়। এবার আমার আকাশ হতে পরার পালা। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রইলাম। এও-কি সম্ভব!
– দেখ, ঘরে আমার দুটো সন্তান। ছোটটার বয়স ১ বছর। বড়টা ৪। হাতে কোন কাজ নেই। পুরোটাই নির্ভর করি স্বামীর উপর। আমাকে ছেড়ে গেলে শুধু আমি নই, দুটো অবুঝ শিশুও না খেয়ে থাকবে। বাকি কিছু শুনতে ইচ্ছে করছিলো না। হাতে ৫ ডলারের একটা নোট ধরিয়ে দ্রুত এখান হতে চলে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। গিন্নী ফিরে মহিলাকে দেখলে হাজার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
এর আগেও ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে হরেক রকম ব্যানার নিয়ে অনেককে ভিক্ষা করতে দেখেছি। এক মহিলার হাতে ছিল…”আমি এতটাই কুৎসিত, পতিতা হয়েও কোন গ্রাহক যোগাড় করতে পারিনা… সাহায্য কর” অন্য একজন, “চার ক্যানের এক প্যাকেট বীয়ার না নিয়ে বাড়ি ফিরলে বউ আজ ঘরে ঢুকতে দেবেনা…কিছু সাহায্য কর”। এমন আরও অনেক কিছু।
আজ প্রায় এক বছর পর অংগরাজ্যের রাজধানী সান্তা ফে গেলাম। শহরটার প্রতি আমার অন্য রকম একটা টান আছে। চাকরি জীবনের প্রথম বছরটা ওখানেই কাটিয়েছি। প্রতিদিন ফ্রীওয়ে ধরে ১১০ কিলোমিটার ড্রাইভ করে সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে এসেছি। ভিন্ন ধরণের একটা শহর। রাজধানী, অথচ উঁচু কোন দালান নেই। করার অনুমতি নেই। শহর দেখলে মনে হবে সেন্ট্রাল আমেরিকার কোন শহরে আছি। দেখতে অনেকটা গুয়েতেমালার রাজধানী তেগুছিগাল্পা অথবা কোষ্টারিকার রাজধানী সান হোসের মত দেখায়। হলিউডের ছবিতে সেন্ট্রাল আমেরিকার কোন দৃশ্য চিত্রায়িত করতে এ শহরকেই বেছে নেয়া হয়। খুবই এক্সেপেন্সিভ শহর। সাথে প্রকৃতির লীলাভূমি। হলিউডের এমন কোন সেলিব্রেটি নেই যার এখানে একটা বাড়ি আছে।
চেনা শহরকে বিষণ্ণতায় ডুবতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। শহরের মূল চত্ত্বরটা আজ ছিল ফাঁকা। অথচ স্বাভাবিক সময়ে এদিনে পর্যটকদের ভীড় নামে। নেটিভ আমেরিকানদের চত্ত্বরে বয়স্ক একজন গীটার বাজিয়ে কান্ট্রি গান গাইছিলো। সামনে এক টুকরা কাপড় বিছানো। সেও সাহায্য চাইছে। তবে বিনিময়ে কিছু একটা দিচ্ছে। অনেকক্ষণ তন্ময় শুনলাম তার গান। চারদিকের খোলা প্রকৃতিতে এমন দরদ দেয়া গান যে কারও মন কাড়তে বাধ্য। আসলে একেক দেশের জীবন একেক রকম হলেও কোথায় যেন একটা সমান্তরাল আছে। আমেরিকার ভিক্ষুক ও ভিক্ষাবৃত্তি দেখলে এ সমীকরণ সহজ হয়ে যায়।