সুডবাহনহফ স্টেশনে এসে দেখি ট্রেন ছেড়ে যেতে আরাে দশ মিনিট বাকি। তেমন লােকজন নেই সম্ভবত সপ্তাহের মাঝামাঝি হওয়ায়। নির্দিষ্ট কম্পার্টমেন্টে এসে লাগেজ রেখে সিট মিলিয়ে বসি। প্রত্যেক বগি দুটি অংশে ভাগ করে প্রতি টাতে চারজন করে বসার ব্যবস্থা। একপাশে লম্বা করিডাের।
ঠিক সােয়া চারটায় গার্ডের হুইসলের সঙ্গে ট্রেন নড়েচড়ে উঠে চলা শুরু করে। এবার আবিষ্কার করলাম এই বগিতে আমি একাই যাত্রী। ভয় ও আনন্দ দুটোই হচ্ছিল।
আমার পােলিশ সহকর্মী মিসেস বের্নাডেট জানিয়েছে, আমার দেশে যাচ্ছাে যাও। তবে সুটেড-বুটেড হয়ে যেও না। আর ট্রেনের কর্মী ছাড়া অন্য কারাে কাছ থেকে কিছু কিনবে না।
ইওরােপের প্রাণকেন্দ্রে এসে এ ধরনের সাবধান বাণী হাস্যকর মনে হলাে।
বের্নাডেট বুঝতে পেরে জোর দিয়ে বললাে, তােমার সঙ্গে আমি কৌতুক করছি না। ছিগয়না বা জিপশিরা বর্ডারে ট্রেন থামলে ঘড়ি অথবা স্বর্ণের চেইন বিক্রির উদ্দেশ্যে ওঠে। তারা একশ ইওরাে দাম হেকে সবশেষে পাচ ইওরােতে বিক্রি করতে রাজি হয় এবং নেমে যাওয়ার আগে সুযােগ বুঝে অন্যের লাগেজ নিজের মনে করে নিয়ে চলে যায়।
বেশ কৌতূহল হলাে। অনেকটা বাঙালি স্টাইল। একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। পথে টঙ্গি বাজারের কাছে গতি একটু কমার সুযােগে নিখুত দক্ষতায় এক সাহসী যুবক জানালায় হাত থাকায় আমার ঘড়িটা ছাে মারে। ততােধিক ক্ষিপ্রতায় হাত সরিয়ে নিলেও ঘড়িটা চেইন ছিড়ে এক সহযাত্রীর কপালে আঘাত করে। ছিনতাই না হলেও ঘড়ির অপমৃত্যু ঘটে।
রাতে ঘুমাবাে না ঠিক করি। হাস্যকর হলেও সত্যি, কোকাকোলা বেশি পরিমাণে পান করলে আমার ঘুম আসে না আর মাথা ব্যথা হলে প্যারাসিটামলের প্রয়ােজন হয় না।
ট্রেন ঘণ্টায় একশ কিলােমিটারের উপরে চলছে। চারদিকে বিস্তৃত মাঠ। অনেক দূরে ছােট খামার বাড়ি। এতাে বিস্তীর্ণ ভূমির মালিকানা একজনের, ভাবতে অবাক লাগে! বাংলাদেশ হলে তাে এই কৃষক জমিদার উপাধি পেতাে কিংবা বারাে ভূইয়ার একজন হতাে!
নির্জন রাস্তা। আমাদের দেশের মতাে রেললাইনের পাশ ঘেষে কোনাে ঘরবাড়ি নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর পাহাড় নজরে এলাে। এমনিতে অস্ফয়াকে পাহাড়ের দেশ ভাবা হয়। ফিরােজ সাই-এর গান মনে পড়ে দুই পাহাড়ের মাঝে মাওলায় মসজিদ বানাইছে। এখানে দুই পাহাড়ের মাঝে সরকার রেললাইন বানিয়েছে।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে চেক (Czech) সীমান্ত এসে পড়ে। অনেক যাত্রী নেমে যায়, দুই একজন উঠলাে। আমাকে একা দেখে এক মহিলা অন্যদিকে চলে গেল ।
কিছুক্ষণ পর সিকিউরিটির লােক এলাে। তাদের ভাষায় পাসপাের্ট দেখতে চাইলাে। ইংরেজির ব্যবহার পূর্ব ইওরােপে খুব কম। অনুমানে ভর করে পাসপাের্ট বাড়িয়ে দেয়ার পর ভিসা দেখে দো বলে চলে যায়।।
অথচ গেল সপ্তাহে ঠিক এ জায়গা থেকে আমাকে ভিয়েনা- তে ফেরত পাঠানাে হয়েছিল। চেক-এর ভিসা না থাকার কারণে। তাদেরকে যতােই বুঝিয়েছি পােল্যান্ডে যাচ্ছি, চেক-এ কোনাে যাত্রাবিরতি করবাে না, এমনকি ট্রেন থেকে নামবাে না। তাদের অনড় জবাব, ফেরত যেতে হবে।
ওদেরকে ভিসা দিতে বলেছিলাম।। ভাবলেশহীন উত্তর ছিল, ভিয়েনাতে চেক এমবাসি থেকে ভিসা নিতে হবে।
ভাগ্য ভালাে। এবার সে রকম কিছু ঘটলাে না। আধঘণ্টা পর ট্রেন ছাড়লাে। স্টেশন সংলগ্ন বিল্ডিং, গাড়ি ও মানুষের পােশাক-আশাক দেখে অস্ফয়ার জীবনযাত্রার সঙ্গে চেকের পার্থক্য ধরা পড়ে। অনেকটা ইনডিয়া-বাংলাদেশের মতাে।
ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে। এখানে সব কৃষি জমি বরফে ঢাকা। যতােদূর চোখ যায়, শুভ্র শাদা বরফের চাদর। প্রকৃতির দুই ভিন্ন রূপ পৃথিবীর দুপ্রান্তে। ইওরােপে বছরের নির্দিষ্ট সময় চাষযােগ্য জমি বরফের কারণে অনাবাদি থাকে আর আমাদের দেশে বর্ষা মরসুমে প্রকৃতি ও ইনডিয়ার বদান্যতায় আবাদী জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়।
মােবাইলে মেসেজ আসার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়ে। চেক ও ইংরেজি ভাষায় আমাকে এ দেশে স্বাগত জানানাে হয়েছে। পর পর দুটো দেশ পেরিয়ে এলাম, অথচ মাঠে কোনাে গবাদি পশু বা কৃষক নজরে পড়েনি। পৃথিবীর সুদ্রতম দৃশ্যের মধ্যে একটি হলাে সবুজ অথবা সােনালি ক্ষেতে কৃষক-কৃষাণীর কর্মব্যস্ততা।
কোণাকুণি লাল সূর্যের আবির্ভাব সন্ধ্যা নামার ইংগিত দেয়। একটু ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ায় হিটারের মাত্রা একটু বাড়িয়ে দরজা লক করে দিয়ে কফির ফ্লাস্ক নিয়ে বসি।
একা ট্রেনের বগিতে এই প্রথম নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হলাে। ঢাকাতে দুটো জায়গা আমার বেশ প্রিয় ছিল। একটা হলাে শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি, অপরটা কমলাপুরের রেল স্টেশন। একাকী স্টেশনের বেঞ্চে অপরিচিত মানুষের চলে যাওয়া দেখতে বেশ লাগতাে। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার সময় কেন জানি না অজানা ব্যথা অনুভব করতাম। এবং মালগাড়ির নিথর চলে যাওয়ার শব্দে মনে হতাে করুণ সুর কে যেন বলছে যাচ্ছি যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি।
একাকী এই নিঃসঙ্গ ভ্রমণে হঠাৎ মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বৃজের ওপর দিয়ে ট্রেন যাওয়ার শব্দে অন্যমনস্কতা ভাঙে। ট্রেনে বসে ট্রেনের চলে যাওয়া দেখতে ভালাে লাগে।
দরজায় আলতাে শব্দে খুলে দেখি ওয়েটার দাড়িয়ে। রাতের খাবারের অর্ডর দিই। খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই দ্বিতীয় দফা ভিসা চেক করতে আসে। লাগেজের দিকে নিরুদ্বিগ্ন দৃষ্টি রেখে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যায়।
চাঁদ বিহীন রাত অসহ্য মনে হয়। মাঝে মধ্যে দুই একটা তারার ঝলকানি দৃষ্টির সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটায়। এভাবে সকাল হয়। তবে সূর্যের দেখা মেলে না। শীতকালে ইওরােপে সূর্যের দেখা ভার ।
পােল্যান্ডের সীমান্তে প্রবেশ করে ট্রেন। এখানে বােধহয় বসন্তকাল। সবুজ মাঠ, গাছে কচি পাতা, মাঠে সর্ষে ফুলের জ্বল জ্বলে হলুদ রঙ, কোথাও আবার সূর্যমুখীর চাষ করা হয়েছে সম্ভবত ভােজ্যতেল উৎপাদনের লক্ষ্যে। জনমানবহীন পরিবেশে পাহাড়ের গা ঘেষে সবুজ মাঠে অসংখ্য নাম না জানা ফুল ফুটে আছে যেন প্রকৃতি আপন ভাবনায় নিজেকে সাজিয়েছে। মনে হয় চিরসবুজের দেশ বাংলাদেশের সবুজ রঙ প্রকৃতি চুরি করে এদেরকে অকৃপণভাবে দান করেছে।
সকাল আটটায় ট্রেন ওয়ারসাে স্টেশনে থামে। প্রচুর কর্মব্যস্ত মানুষ এখানে। চেহারায় নিরীহ ভাব। তবে জৌলুস নেই। কমিউনিজমের ছােয়া এখনাে চোখে পড়ে। ট্রেন চলে যায় ওয়ার্কশপে, আমি ওয়ারসাে-তে | মােবাইলে রিং বাজে, লেখা ওঠে পােল্যান্ডে স্বাগতম।
- অষ্টয়া থেকে মােহসীন ভূঞা
— অনলাইন থেকে সংগৃহীত