আজকের জুমার দিনটা আর দশটা দিনের মত স্বাভাবিক ছিলনা। রতনগঞ্জে সকাল হতে একধরনের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। আগের রাতে মাইকিং করা হয়েছে। ইলশা হাজীর নেতৃত্বে গুটি কয়েক গ্রামবাসী মশাল মিছিলও করেছে। 'নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর' ধ্বনীতে থেমে থেমে কেঁপে উঠেছে গোটা গ্রাম।
হরমুজ আলীর বিচার হবে। বিচারকের আসরে বসবেন গঞ্জের বাজার হতে আসা মুফতি ওয়ালিওল্লাহ। সাথে থাকবেন রতনগঞ্জ মসজিদের ইমাম ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন।
হরমুজ আলী ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন। কোন মতেই তাকে এ যাত্রায় রেহাই দেয়া যাবেনা, এমনটাই স্থানীয়দের মত।অতি উৎসাহী কিছু যুবক ইতিমধ্যে তার দু'হাত বেধে কপালে ছোট এক টুকরা পাথর রেখে সূর্যের দিকে মুখ করে দু'ঘণ্টার জন্যে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করেছে।
তার অপরাধ, জেনেশুনে সে আল্লার কালামের উপর পা মারিয়েছে।
ঘটনার চাক্ষুস স্বাক্ষী মসজিদের ইমাম সাহেব।
আগের রাতে এশার নামাজের পর ইমাম সাহেব বিশদ বর্ননা দিয়েছেন হরমুজ আলীর কৃত অপরাধের।
মসজিদের বাইরে পবিত্র কোরাণের দুটো ছেড়া পাতা বাতাসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। হরমুজ তা দেখেও পাতা দুটোর উপর পা রেখেছিল।
ইমাম সাহেবের ভাষায়, পা রাখার সাথে সাথে খোদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। তিনি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছেন গায়েবি আওয়াজ...হে নিয়ামত উল্লাহ, হরমুজকে শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত আমি কবরে ফিরে যাচ্ছিনা।
ইমাম সাহেব মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচ বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান মরহুম হুজ্জাত বেপারির ছায়াও নাকি দেখতে পেয়েছেন।
মাসজিদের নিজস্ব জমির উপর সামীয়ানা টানানো হয়েছে। হরমুজের জন্যে বানানো হয়েছে বাঁশের খোয়াড়। নামাজ শেষে সবাই ওদিকে রওয়ানা দিচ্ছে। গঞ্জের মুফতি সাহেব আগেই এসে গেছেন। গ্রামবাসীর সাথে জুমা আদায় করেছেন। চেয়াম্যান সাহেবও আজে দেরী করেননি।
সবার সাথে বিচার মাহফিলে যোগ দিয়েছেন সদ্য বিদেশ ফেরত ছ্যার ছ্যার আলী। একাধারে ১৫ বছর মধ্যপ্রাচ্যে কাটিয়ে সপ্তাহখানেক আগে বাড়ি ফিরেছেন। তার ১৫ বছরের কিশোর সন্তানই তাকে টেনে এনেছে হরমুজ আলীর বিচারে।
ইমাম সাহেবের কোরান তেলওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় বিচারকর্ম। স্বাক্ষী প্রমাণ হিসাবে তিনি নিজেই উপস্থাপন করেন সযত্নে রক্ষিত কোরানের দুই পাতা।
উপস্থিত জনতার ধিক্কারে জর্জরিত হয়ে গেল হরমুজ আলী। তার একটাই দাবী; চোখে কম দেখার কারণে দেখতে পায়নি।
বিচারকার্য শেষ করতে চেয়ারম্যান সাহেবের তাগাদা ছিল। তাই রায় ঘোষণা দিতে মুফতি সাহেব খুব একটা দেরী করলেন না।
হরমুজ আলীর বাড়িঘর উচ্ছেদ করে তাকে গ্রাম ছাড়া করা হবে। যাবার আগে মাথা কামিয়ে গলায় এলুমুনিয়ামের কলসি ঝুলিয়ে রতনগঞ্জ গ্রামের সবকটা গলি ঘুরানো হবে।
ছ্যার ছ্যার আলী নড়ে চড়ে বসলেন। লম্বা সময় আরব দেশে থাকায় আরবী ভাষাও রপ্ত করে নিয়েছেন। মঞ্চের কাছাকাছি এসে ইমাম সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জোরে কয়েকটা কাশি দিলেন।
ইমাম সাহেব দৃষ্টি ফেরাতে নিজের পরিচয় দিলেন এবং পবিত্র কোরানের কোন দুটি পাতার অবমাননা হয়েছে তা স্বচক্ষে দেখতে চাইলেন।
ইমাম সাহেবের চোখের পাতা ততক্ষণে ভিজে গেছে। কোন রকমে কান্না চেপে ছ্যার ছ্যার আলীর হাতে তুলে দিলেন পবিত্র কোরাণের দুই পাতা।
পাতা দুটো হাতে নিয়ে ছ্যার ছ্যার টাসকি খেলেন। মাথা চক্কর দেয়ায় বসে পড়লেন মাটিতে।
চারদিকে হৈ চৈ পরে গেল। দু'একজন গঞ্জের ডাক্তারকে ফোন দিতে শুরু করল। লম্বা সময় ধরে মাথায় পানি দেয়ার পর ছ্যার ছ্যারের মাথা জায়গায় ফিরে আসল।সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে এবং জানতে চাইল চক্করের কারণ।
ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল ছ্যার ছ্যার। সবাইকে উদ্দেশ্য করে লম্বা সালাম দিল। আরও একবার নিজের পরিচয় দিল এবং সামনের আমজনতাকে অবহিত করল তার আরবী জ্ঞান।
'বেরাদেরানে মিল্লাত ও আমার প্রিয় রতনগঞ্জের ভাই বোনেরা। আমার হাতে যে পৃষ্টা দুইডা দেখছেন তার মালিক আমি। আমিই তাদের রাস্তায় ছুইড়া ফেলছি। পাতা দুইডা কোরাণের পাতা না। দুবাই এয়ারপোর্টে খরিদকরা ম্যাগাজিনের পাতা। পাতায় কোন কোরাণের আয়াত নাই। আছে মিশরের বিখ্যাত গায়িকা কাউকাব আল-সারক্'এর কালা কাহিনী। এই বেটি কয় বেটার লগে মহব্বত আর কয় বেটার লগে ঘুমাইছে তার গরম কাহিনী। আমার কতা বিশ্বাস না হইলে গঞ্জের দিকে চলেন, ঐহানে লাইবেরির মালিক ধনা মিয়া আরবী জানে, তারে পড়তে দেন। ভুল হইলে আমারে শাস্তি দিয়েন...
গ্রামবাসী পরল ব্যপক ফাঁপড়ে। কার কথা বিশ্বাসকরে কোনদিকে যাবে তা স্থির করতে অনেকেই কষ্ট পেল। ইমাম সাহেব ক্ষেপে গেলেন। তেড়ে গেলেন ছ্যার ছ্যারের দিকে। কেন গেলেন তা অনেকের কাছেই রহস্য রয়ে গেল!
*****কুমিল্লার পুজার মন্ডপে রক্ষিত কোরাণ কি আসলে কেউ পড়ে দেখেছে, নাকি বাইরের আরবী লেখা দেখেই ধর্মীয় চেতনার লাভা উগড়ে উঠেছিল!******
পরিচয়ঃ
১) নিয়ামত উল্লাহ ইমামঃ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ৫বারের চেয়ারম্যান মরহুম হুজ্জাত আলীর জামাতা। হুজ্জাত তার মরহুমা আম্মাজানের সাথে সহবাস করার সময় ২০ বছরের কিশোর নিয়ামত উল্লাহ দেখে ফেলে। নিজের কন্যাকে বিয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হন নিয়ামত চেয়ারম্যান। উপঢৌকন হিসাবে মসজিদ বানিয়ে তার ইমাম বানিয়ে দেন জামাতাকে।
২) গঞ্জের ইমাম মুফতি ওয়ালিওল্লাহঃ স্থানীয় এম্পি সাহেবের ডানহাত। মাসজিদের আয় রোজাগার নিজে যেমন খান, পাশাপাশি এম্পি সাহেবের সাথেও শেয়ার করেন।
৩) আসামী হরমুজ আলীঃ এককালের রিক্সা চালক। ইদানিং চোখে কম দেখার কারণে ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
৪) ছ্যার ছ্যার আলীঃ এই বেচারা লম্বা সময় বিদেশে থাকার কারণে তার ভালমন্দ কিছু জানা যায়নি। জানতে পারলে আগামীতে জানাবো ইনশাল্লাহ।