ইমেইলের তখনও প্রসার ঘটেনি। হাতে লেখা চিঠি ইনভেলপে ভরে মেইল করার ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের যোগাযোগ। সেই সময়েই মহা তৎপর ছিল এই চক্র। নাইজেরিয়ান স্ক্যামিং নেটওয়ার্ক।
মৃত্যু পথযাত্রী প্রাক্তন কোন জেনারেলের স্ত্রী শেষ বয়সে এসে উপকার চাইছেন। নাইজেরিয়ান আর্মির এই জেনারেল চাকরি-কালীন সময় যে কোন উপায়েই হোক বিলিয়ন ডলারের মত কামাই করেছিলেন।
ওসব ডলার এখন দেশের বাইরে না আনলে দেশটার সরকার ক্রোক করে ফেলবে। এই বিপুল অংক বাইরে আনতে একজন বিদেশীর সাহায্য দরকার।
আমি আপনি সেই বিদেশী। মানি লন্ড্রি'এর মিশন সফল হলে বিলিয়ন ডলারের একটা বিশাল অংক জমা হবে আমার আপনার ব্যাংক একাউন্টে।
প্রথম যোগাযোগে আপনাকে শুধু মিশনে অংশগ্রহণের সম্মতি জানাতে হবে। রাজি হলে শুরু হবে ট্রান্সফার প্রসেস।
এ ধরণের একাধিক চিঠি ও ইমেইল আমার বরাবরও পাঠানো হয়েছিল। শুরুটা সিডনি হতে। তবে সস্তা এসব ধাপ্পাবাজির সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল আমার এক বন্ধুর কারণে।
বন্ধুর বাবা ছিলেন দেশের একজন নামী রাজনীতিবিদ। জাত শিল্পপতি সেই অখণ্ড পাকিস্তান আমল হতে।
তিনি পা দিয়েছিলেন নাইজেরিয়ান ফাঁদে। ব্যপার অনেকদূর গড়িয়েছিল। লন্ডনে একজনের সাথে দেখা করতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
সর্ব সাকুল্যে আড়াই লাখ ডলার গচ্চা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন নাইজেরিয়ান স্ক্যামের আমলনামা। এই ঘটনা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছর পরের ঘটনা।
স্ক্যামের ঘটনা প্রবাহ খুব সহজ সরল। প্রথম ধাক্কায় আপনাকে একটা ফি পাঠাতে হবে কথিত ধনী বিধবার নামে।
ঐ অংক খোয়া যাওয়ার পরও যদি আপনার ঘুম না ভাঙ্গে পরবর্তী ধাপ হবে লন্ডনের মত পশ্চিমা কোন ইউরোপিয়ান দেশের ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হবে। ঐ একাউন্টে চোখে পররা মত একটা এমাউন্ট জমা করতে হবে। কারণ নাইজেরিয়ান সোর্স যেনতেন একাউন্টে বিলিয়ন ডলার ট্রান্সফার করতে যাবেনা।
আপনার নামের ব্যাংক একাউন্ট হলেও তা অপারেট করার অধিকার থাকবে নাইজেরিয়ান 'বিধবা'রও।
আপনি যতটা সম্ভব ঐ একাউন্টে জমা করলেন এবং ইমেইল অথবা তাদের দেয়া ফোন নাম্বারে ফোন করে জানিয়ে দিলেন ট্রান্সফারের কথা।
খেলা ফাইনাল! ভোজবাজির মত ওভার-নাইট বদলে যাবে সবকিছু। ব্যাংক একাউন্ট নিমিষের ভেতর ফাঁকা হয়ে যাবে। একটিভ ফোন নাম্বার ঠাঁই নেবে মৃত্যুপুরীতে। থিন এয়ারে মিলিয়ে যাবে 'বিধবা' ও তার বিলিয়ন ডলারের কেচ্ছা।
আপনার আমার মত সবাই স্মার্ট না। লোভে পরে অনেকেই পা বাড়ায় এ পথে। এবং সবকিছু খুইয়ে ধর্না দেয় পুলিশের দুয়ারে। তবে ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে নাইজেরিয়ান চক্র।
মার্কিন টিভি চ্যানেল CBS'এর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 60 MINUTES একবার বেনিফিসিয়ারি সেজে উন্মোচন করেছিল এদের নেটওয়ার্ক।
লাগোস সহ দেশটার অনেক শহরে স্ক্যামের ইন্ডাস্ট্রি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন উপস্থাপক ক্রিস হ্যানসন।
লন্ডন, প্যারিস,মাদ্রিদ সহ ইউরোপের অনেক দেশে ওদের আস্তানা।
এই লেখাটা এ সময় টেনে আনার একটা উপলক্ষ আছে। আমার বড় বোন ছিলেন ল'ইয়ার। গেল বছর নিউ ইয়র্কে করোনায় মারা যাওয়ার আগে প্রতি বছর অন্তত ছয় মাস কাটাতেন এখানে। দেশের ওকালতি এখানে এসেও চালিয়ে যেতেন। অনলাইনের সমর্থন ছিল আমার অংশ।
২০১৭ সালে জরুরি কারণে ফোন করলেন আমাকে। অনুরোধ করলেন এখনি যেন লন্ডনে জনৈক বাংলাদেশির একাউন্টে দুই হাজার ডলার ট্রান্সফার করি। ট্রান্সফারের সমর্থনে ডকুমেন্ট পাঠানো মাত্র বাংলাদেশে আমার একাউন্টে টাকা গুলো জমা হয়ে যাবে।
সাধারণত বড় বোনের এমন অনুরোধে প্রশ্ন করিনা। কিন্তু এ যাত্রায় কেমন যেন সন্দেহ হল। গোটা ব্যপারটা খুলে বলার জন্যে অনুরোধ করলাম।
তখনই বেরিয়ে এলো ভেতরের কাহিনী। সেই নাইজেরিয়ান স্ক্যাম!
বোনকে খুলে বললাম সবকিছু। এবং অনুরোধ করলাম উনার ক্লায়েন্টকে সাবধান করতে।
বাংলাদেশি ভদ্রলোক আমার উত্তর শুনে ক্ষেপে গেলেন। অত্যন্ত বাজে কিছু মন্তব্য করে নিজের প্রতিক্রিয়া জানালেন।
আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। সুস্থ থাকাবস্থায় কাউকে আমি এ পথে পা বাড়াতে সাহায্য করবোনা।
বলাই বাহুল্য বাংলাদেশি ভদ্রলোক ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুরন্ত দুর্বার একজন লুটেরা।
প্রায় দেড় বছর পর সর্বসাকুল্যে ৫ লাখ ডলার সোগামারা দিয়ে উপলব্ধি করলেন বাস্তবতা। এবং বড়বোনের কাছে হায় হায় করলেন আমার কথা না শোনার জন্যে।
পুনশ্চ: স্প্যানিশ লটারি চক্র নাইজেরিয়ান স্ক্যামের মতই অর্গেনাইজড একটি ক্রাইম সিন্ডিকেট। সাবধান থাকবেন এসব হতে।