বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রাক্তন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জেলে যাওয়া কোন ঘটনা না। এসব দেশকে খবরের তুঙ্গে রাখতে স্থানীয় সংবাদই যথেষ্ট। এই যেমন আরাভ খান ও তার দুবাইস্থ জুয়েলারি দোকানে ৪৫ কোটি টাকার স্বর্ণের বাজপাখি। একজন খুনি দেশটার আইন ও ব্যবস্থাকে ম্যানেজ করে নিজের জেলটার্ম তৃতীয় একজনকে দিয়ে খাটায় এবং নিরাপদে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গিয়ে নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হয়। পরিবর্তীতে দুবাইকে গিয়ে ফেঁদে বসে এমন এক ব্যবসা যা কোন সাধারণ বাংলাদেশির জন্যে আকাশ কুসুম কল্পনা কেবল। স্বৈরতান্ত্রিক লুটেরা দেশের এসব ঘটনায় আমরা কেন নতুন করে অবাক হই তা বুঝার মগজ আমার নেই।
ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা ইতিমধ্যে আওয়াজ দিয়েছেন যে আরাভ খানের উত্থানে তেনার কোন হাত নেই। এ আওয়াজই নিশ্চিত করে দেয় তেনার সম্পৃক্ততা। কারণ এটা যে লুটেরাদের অভয়ারণ্য বাংলাদেশ। এখানে লুটের ধান্ধার অপর নামই রাজনীতি।
দুয়ারে ৪৫ কোটি টাকার বাজপাখি ঝুলিয়ে যে তরুণ ব্যবসা শুরু করতে পারে তার ব্যবসার মূলধন কত হতে পারে তা কল্পনা করার মত উদ্ভাবনী শক্তি আমার মত অনেকেরই নেই। তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না আরাভ খান ঐ ব্যবসার মুখপাত্র মাত্র। আড়ালে আবডালে লুকিয়ে আছেন এমন একজন যার মুখ হতে নিত্য নির্গত হয় চেতনার লাভা। ন্যায় অন্যায়, পাপ-পুণ্য, বিচার ও শাস্তি নিয়ে যিনি সদা আমাদের পথ প্রদর্শন করে থাকেন। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় লালিত পুলিশের আবুল বেনজির কি সে আসনে বসার যোগ্য ব্যাকটি নন? বেনজিরের জায়গায় শেখ হাসিনার পুত্র জয়কে বসালেও কি খুব অন্যায় হবে?
বাংলাদেশ মরা লাশ হয়ে এখন মর্গে শুয়ে আছে এবং ওখানে শকুন ও শেয়ালদের মেলা জমে নিত্য। আমরা কম্প্রোমাইজ করে ফেলেছি আমাদের বাস্তবতার সাথে। এবং নিজেরাও শিয়াল কুকুর বনে মর্গের বখরা আদায়ের দৌড়ে শামিল হয়ে আছি। এসব নিয়ে শোরগোল করা এক ধরণের জুচ্চুরি, আত্মপ্রতারণা।
শুরু করেছিলাম প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে। তার পতনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশে এটা বিশেষ কোন খবর না হলেও উন্নত বিশ্বে এ নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে সামনের সপ্তাহের কোন একদিন একসময়ে বিশ্বের সবচাইতে পাওয়ারফুল এই ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করা হতে পারে।
কি অপরাধে জেলে যেতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?
আসুন একটু ঘেঁটে দেখি এবং তুলনা করি আরাভ খান বাস্তবতার সাথে।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় মনোনয়ন পান নিউ ইয়র্কের ধনকুবের ডোনাল্ড জন ট্রাম্প। বর্ণবাদকে পুঁজি করে সাদা আমেরিকানদের কিচেন টেবিলে প্রবেশ করতে সক্ষম হন চরিত্রহীন এই ব্যবসায়ী। সাথে বহন করে নিয়ে আসেন বিশাল এক ব্যাগেজ।
অনেক কিছুর সাথে এই ব্যাগেজে লুকিয়ে ছিল স্টর্মি ড্যানিয়েল নামের এক দেহপশারিনী যাকে ভাড়া করে ভোগ করেছিলেন এক হোটেলে।
নিজের বৈধ আয় হতে দেহ-ব্যবসায়ী ভাড়া করা নীতি নৈতিকতার সাথে সাংঘর্ষিক হলেও আইনের চোখে তা কোন অপরাধ নয়। এমন ঘটনা আমেরিকান রাজনীতিবিদদের সাথে অহরহই ঘটে থাকে। তা হলে এমন কাজের জন্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেন গ্রেফতার করা হবে?
ট্রাম্প তার ফিক্সার ও আইনজীবী মাইকেল কোয়েনকে দিয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার পেমেন্ট করেছিল স্টর্মি ড্যানিয়েলকে। উদ্দেশ্য?
উদ্দেশ্য খুব সোজা। সামনে নির্বাচন। এমন সময় এই দেশপশারিনী মুখ খুললে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হবে ভোটারদের। বিশেষকরে নিরপেক্ষ ভোটারদের মাঝে যাদের ভোটেই নির্ধারিত হয় আমেরিকান প্রেসিডেন্সির ভাগ্য। ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত জীবনের অন্ধকার দিক ধামাচাপা দেয়ার জন্যেই এ অর্থ, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় হাশমানি।
ঘটনা ঘটেছিল নিউ ইয়র্কে। তাই তার লিগ্যাল ইমপ্লিকেশনও এই শহরের। ট্রাম্পের অন্যায় এখানে দুটি।
এক, যেহেতু এই অর্থ একজনের মুখ বন্ধ করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে লাভবান হওয়ার চেষ্টায় করা হয়েছিল তাই এই অর্থ ব্যায়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে জানাতে বাধ্য ছিল ট্রাম্প ও তার ক্যাম্প। কিন্তু তার তা করেনি। মার্কিন নির্বাচন আইনে এ হচ্ছে ক্যাম্পেইন ফাইন্যান্স ফ্রড।
দুই, হাশ মানি যে পথে পেমেন্ট করা হয়েছিল তা ছিল এক ধরণের জালিয়াতি। ট্রাম্পের ফিক্সার মাইকেল কোয়েন নতুন এক কোম্পানি বানিয়ে তার ব্যানারে শোধ করেছিল এই অর্থ। একই অর্থ ট্রাম্প তার নিজ কোম্পানি চেকে নিজে সই করে শোধ করেছিলেন কোয়েনকে।
এবার আসুন বিবেচনা করে দেখি বাংলাদেশের কনটেক্সটে কি অন্যায় করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ZERO!!!
কারণ বাংলাদেশের বিবেচনায় হোসেন মোহম্মদ এরশাদ ... থুক্কু, ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন অন্যায় করেননি। তিনি তা করতে পারেন না। সবটাই ছিল তার চরিত্র হনন করে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যে প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র!
ক্যাম্পেইন ফাইন্যান্স! হোয়াটা দ্যা এফ...দিস ইজ! আমার পয়সায় আমি মাস্তি করবো তা আবার নির্বাচন কমিশনে রিপোর্ট করতে হবে...আমেরিকান রাজনীতির এসব ফাঁক-ফোকর লেভেল করতে চাইলে তাদের উচিৎ হবে আমাদের সাথে (বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের) যোগাযোগ করা।
সে যাই হোক। ট্রাম্প আসলেই গ্রেফতার হবেন কিনা তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। হলেও তা হবে খুবই ক্ষণস্থায়ী এবং ব্যাপক দেন-দরবারের পর। তিনি হয়ত ডিসট্রিক্ট এটর্নির অফিসে এসে কিছুক্ষণ বসবনে। কিছু কাগজে সই করবেন এবং জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাবেন। এবং একজনকে বিচারের আওতায় আনতে আমেরিকায় এটাই যথেষ্ট।
ট্রাম্প জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেলেও তার বিচার শুরু হবে (যদিও নিউ ইয়র্কের ডি এ অফিস নিশ্চিত করেনি ক্রিমিনাল কেস হিসাবে বিবেচিত হবে কিনা ট্রাম্পের অপরাধ)। উন্মোচিত হবে আমেরিকার বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার দিক। দোষ স্বীকার করে কিছু জরিমানা দিয়ে ছাড় পাওয়ার দিকে না এগোলে শুরু হবে অল-আউট বিচার। গঠন করা হবে জুরি টীম। ট্রাম্পকে উকিল সহ নিয়মিত হাজিরা দিতে হবে কোর্টে। শুনানি শেষ জুরি টীম নির্ধারণ করবে ডোনাল্ড জন ট্রাম্পের ভাগ্য। জুরি কর্তৃক দোষী বিবেচিত হওয়ার পর বিচারক ঘোষণা করবেন শাস্তি। যদি এ পর্যন্ত গড়ায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যৎ সামান্য জরিমানা দিয়ে বেরিয়ে আসবেন এই মেগা আসামী। বেরিয়ে আসলেও কুপোকাত হবে তার রাজনৈতিক ভাগ্য।
বাংলাদেশের অপরাধ ও শাস্তি পর্বের সাথে এখানেই পার্থক্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। আরাভ খান, বেনজির আর জয় নাম ও পরিচয় এখানে মুখ্য হয়না, মুখ্য হয় তাদের অপরাধ।
মার্কিন বিচার ব্যবস্থার অংশ জুরি ডিউটিতে আমি নিজে যোগ দিতে যাচ্ছি এই সোমবার। এক সপ্তাহ শুনতে হবে আসামী পক্ষ ও প্রসিকিউটরের যুক্তিতর্ক। এবং তারপর রুদ্ধকক্ষে বসে টীমের বাকি সদস্যদের সাথে বিশ্লেষণ করতে হবে উত্থাপিত আর্গুমেন্ট। যদি প্রসিকিউশন আসামীর অপরাধ beyond reasonable doubt প্রমাণ করতে সক্ষম হয়ে থাকেন তবেই জুরি টীম রাজী হবে তাকে শাস্তি দিতে। এবং তা হতে হবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। জুরি টীমের একজন দ্বিমত করলে গোটা বিচার আখ্যায়িত হবে মিস-ট্রায়াল হিসাবে। এমনটা হলে প্রসিকিউশন সিদ্ধান্ত নেবে আসামীকে নতুন বিচারের সন্মুখিন করবে কিনা।
এক সপ্তাহের এই জুরি ডিউটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার মুখ খোলার অধিকার থাকবেনা...