একসময় সমাজতন্ত্রের মক্কা হিসাবে বিবেচিত হতো ধ্বসে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন শহর পেত্রোগ্রাদ, যা অক্টোবর বিপ্লবের পর লেনিনগ্রাদ নামে পরিচিত ছিল। সে রামও নেই, রাজ্যও নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন ইতিহাস। একই সাথে ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে লেনিন ও তার শহর লেনিনগ্রাদ। রূপান্তরিত সেন্ট পিটার্সবার্গ নাম আমাদের নিয়ে যায় জার-তন্ত্রের রাশিয়ায়। নিয়ে যায় ধর্ম ও রাজপ্রাসাদের যৌথ শাসনের কালো অধ্যায়ে।
সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্রের অপর নামই ছিল সমাজতন্ত্র। আসলেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত দেশে সবাই ছিল সর্বহারা, এক্সসেপ্ট পার্টি পলিটব্যুরোর একদল এলিট।
সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে অনেক কিছু। বদলেছে সর্বহারাদের চেহারা। ওরা আগের মত আর চাতক কায়দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেনা লাইনে। প্রতিদিনের গ্রোসারীর জন্যে ব্যায় করেনা সুস্থ জীবনের শতকরা ৩০ ভাগ সময়। ওরা এখন আধুনিক সর্বহারা। ওদের নেই কথা বলার স্বাধীনতা, নেই ভোট দেয়ার স্বাধীনতা, সমালোচনা গুলাগে নির্বাসিত হওয়ার মতই অপরাধ, যার শাস্তি জেল অথবা মৃত্যু।
পলিটব্যুরোতেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ঐ ব্যুরোতে আগের মত একাধিক মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধ নেই, আছে জুডো ক্যারাটি শিক্ষায় শিক্ষিত একজন তুলনামূলক তরুণ। তিনিই সব। তিনিই প্রথম এবং তিনিই শেষ। যেমনটা ছিলেন রোমানভ ডাইনাষ্টির জারের দল অথবা লৌহমানব জোসেফ স্তালিন ও তার লাল বাহিনী।
প্রাইভেট সৈন্যবাহিনী তৈরি করে পৃথিবীর দেশে দেশে একনায়কদের পকেট হতে কিছু কামিয়ে নেয়ার ধারণাটা যে রান্নাঘরের রাঁধুনি ইভগেনেই প্রিগোঝিনের মগজ হতে বের হয়নি তা বুঝতে সর্বহারাদেরও অসুবিধা হয়না।
ভালই চলছিল এই ব্যবসা। পৃথিবীর বিভিন্ন এন্টারটেইনিং শহরে রুশ পতিতাদের প্লাবনের মতই দেশটার প্রাইভেট বাহিনী ভাগনারের পদাচারনায় মুখরিত হয়ে উঠছিল আফ্রিকার অনেক দেশ। সিরিয়া, লিবিয়া সহ পৃথিবীর অনেক রাজা-বাদশা সহ স্বৈরশাসকের দল ভাড়া করছিল রুশ প্রাইভেট বাহিনীকে। আফ্রিকার দেশ নাইজারে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে বন্দুকের নলের মুখে সদ্য ক্ষমতা দখল করা সামরিক শাসকরাও দেন-দরবার করছিল প্রিগোঝিনের সাথে।
কিন্তু হায় সে পাচককে একদিন রান্নাঘর হতে তুলে এনে বিলিয়ওনিয়র বানিয়েছিলেন সেই প্রিগোঝিনই ক্ষমতার ছত্রছায়ায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেন। হয়ত সর্বহারাদের পলিটব্যুরোর গন্ধ পেয়েছিলেন। হঠাৎ করেই নিজ বাহিনীর সদস্যদের ইউক্রেইন ফ্রন্ট হতে সরিয়ে এনে হুমকি দিচ্ছিলেন বিদ্রোহের। অখুশি ছিলেন রুশ জেনারেলদের উপর। এমনকি বাহিনী নিয়ে মস্কোর দিকে এগুচ্ছিলেন।
নব্য সর্বহারাদের একনায়ক প্রমাদ গুনলেন এবং শান্তি চুক্তির মাধ্যমে দফারফা করলেন প্রিগোঝিনের সাথে। প্রিগোঝিন নিজকে বিজয়ী ভেবে চালিয়ে গেলেন নিজের বিত্ত বৈভবের জীবন।
পলিটব্যুরোর একমাত্র সর্বহারা হয়ত মনে মনে হাসছিলেন এবং সময় গুনছিলেন প্রতিশোধের।
১০ জন সঙ্গী সাথী সহ প্রাইভেট বিমানে করে প্রিগোঝিন মস্কো হতে সেন্ট পিটার্সবার্গের দিকে যাচ্ছিলেন। এবং এটাই ছিল ভাগনার বাহিনীর প্রধানের শেষ যাত্রা। মধ্য আকাশে আগুনের ফুলকি দেখে নিশ্চয় অধুনা জার ক্রূর হাসি হেসেছিলেন। আন্তর্জাতিক আদালতের স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী, শত শত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হাত নিয়ে প্রিগোঝিনের পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। পুতিন খুন করিয়েছেন প্রিগোঝিনকে।
ক্ষমতা নিয়ে দুই কুকুরের কামড়া কামড়িতে আবারও জয়ী হয়েছেন ২০ বছরের অধিক ক্ষমতার থাকা রুশ পলিটব্যুরোর একমাত্র সদস্য ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরভিচ পুতিন।
আসলেই সর্বহারাদের হারানোর কিছু নেই। ওরা ইউক্রেইনের মাটিতে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে অথবা আকাশ হতে লাশ হয়ে মাটিতে পরলেই বা কার কি ক্ষতি। ওরা আগেও ছিল সর্বহারা এখনও তাই এবং সামনে আরও হাজার বছর সর্বহারা হয়ে থাকবে। বদলাবে কেবল পলিটব্যুরোর চেহারা।