চলুন হাতে কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর আমেরিকার দেশ কলোম্বিয়া হতে ঘুরে আসি।
কোন দেশই এখন দূরের দেশ না। একদিকে সোশ্যাল মিডিয়া, পাশাপাশি ভ্রমণ পিপাসুদের বাধনহীন ভ্রমণ ছোট করে ফেলেছে আমাদের পৃথিবী। তাই কলোম্বিয়া ভ্রমণকে লম্বা করবোনা।
রাজধানী বগোটা হয়ে উত্তর-পশ্চিমের শহর সান্তা মার্তা পাড়ি দিয়ে ক্যারিবিয়ান সাগর পাড়ের শহর কার্তাজেনায় পৌছে গেছি আমরা।
শহরটায় বছর জুড়ে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।
একদিকে সাগরের হাতছানি, পাশাপাশি কলোম্বিয়ান ললনাদের উদ্দামতা, অনেক কিছুই আকর্ষন করে পর্যটকদের। অবশ্য এসবের পাশাপাশি আমার জন্যে আরও একটা কারণ ছিল পৃথিবীর এ অংশে পা রাখার।
প্রিয় লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তার বিখ্যাত উপন্যাস One Hundred Years of Solitude'এর একটা অংশ এ শহরে বসেই লিখেছিলেন। এ নিয়ে গর্বের শেষ নেই শাহরবাসীর। ট্যুর গাইডদের তালিকার প্রথমদিকেই থাকে লেখকের বাসস্থানের ঝুলন্ত ব্যালকনি। ওখানে গিয়ে থেমে যায় ঘোড়াগাড়ি। শক্ত কালো পাথরের রাস্তায় খুব হাল্কা করে পা রাখে সবাই। সন্মান জানায় লেখকের প্রতি।
শহরে নৈশ জীবন অন্যরকম। ক্যারিবিয়ান বীচের পাশেই জমে উঠে বার্বা-কি'র আসর। স্বল্প বসনা ললনাদের সাথে মিশে যাওয়া পতিতাদের সহজে আলাদা করা যায়না। রাতভর চলে পান-আহার। বীচের নির্জন স্থানে কপোত-কপোতির উন্মুক্ত যৌণমিলনও অস্বাভাবিক কিছুনা।
কার্তাজেনা ভ্রমণের প্রথম রাতেই Chiva Tour ট্যুরে নাম লেখাই। কালারফুল ছোট আকৃতির একটা বাসে করে রাত কাটানোর নামই Chiva Tour। পর্যটকদের সঙ্গ দেয় স্থানীয় একটা ব্যান্ড। সাথে থাকে অফুরন্ত মদ। ব্যান্ড গায়, সাথে নর্তকীরা নাচে উত্তর আমেরিকার বিখ্যাত ম্যারেঙ্গে নাচ।
নাইট আউটের প্রস্তূতি নিয়েই বাসে উঠেছি। গোটা দশেক পর্যটক। গলায় মালা পড়িয়ে সবাইকে স্বাগত জানালো। হাতে ধরিয়ে দিল স্থানীয় একটা বাদ্যযন্ত্র। উদ্দেশ্য, সারা রাতের সীমাহীন মাস্তি।
শুরুটা হল পরিচয় পর্ব দিয়ে। পর্যটকদের সবাই নিজেদের নাম ও কান্ট্রি অব অরিজিন জানিয়ে বন্ধুত্বের হাত উন্মুক্ত করে দিল। বেশিরভাগই প্রতিবেশী ভেনিজুয়েলা হতে। সাথে ক'জন মেক্সিকান ও অস্ট্রেলিয়ান।
নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ান পরিচয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশি অরিজিন টানতেও ভুল করলাম না। ২/১ জন সাদা অজি বাদে সবাই কয়েক মিনিট ধরে তালি দিয়ে আমার বাংলাদেশি পরিচয়কে স্বাগত জানালো।
আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে বোবা হয়ে গেলাম...কারও পরিচয়ে কেউ তালি দিলনা, অথচ আমার বেলায় এ কেমন রেসপন্স!
উত্তরটা দিল একজন ভেনিজুয়েলানঃ
- তোমাদের ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। তার ধ্যান ধারণা বদলে দিচ্ছে আমাদের সমাজিক ও অর্থনীতির চিত্র। তুমি নিশ্চয় গর্বিত ডক্টর মোহম্মদের দেশে জন্ম নিয়ে!
ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসের উপর তেমন কিছু জানতাম না তখন। শুধু জানতাম আমাদের দেশে এমন একজন আছেন যার নাম ও কর্ম পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে পরছে।
বাংলাদেশের নিম্ন আদালত ৬ মাসের জেল দিয়েছে বিশ্ব সমাদৃত ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে। অপরাধ! আদালতের মতে শ্রম আইন ভঙ্গ করেছেন তিনি। ব্রাভো বিচারক সাহেব!
সুদে আমাদের অনেকের অনেক রকম এলার্জি আছে। সমাজতন্ত্রের বগবাজদের কাছে এ হচ্ছে শোষণ, ধার্মিকদের কাছে সুদ হচ্ছে অমার্জনীয় পাপ। সে বিবেচনায় দেশের অনেকের কাছে ইউনুস স্যার সুদখোর পাপী।
কিন্তু হায়, শোষন সংজ্ঞার প্রবক্তা সমাজতন্ত্র এখন জাদুঘরের আর্টিফেক্ট।
অনেককে দেখেছি প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র হতে সুদ উঠিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন এবং মসজিদে গিয়ে মোনাজাত করছেন সুদখোরদের ধ্বংস করে দিতে।
বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে ঋণ। আমরা ঋণ নেই বিশ্ব ব্যাংক হতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল হতে। ঋণের আশায় ধর্ণা দেই ইউএস এইড, চাইনিজ সরকার সহ সম্ভাব্য সব ধরণের অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানে। সরকার সুদ দিয়ে টাকা ধার করে এবং সে ধারের টাকায় তেল ক্রয় করে পরিবহন খাত সচল রাখে। আপনি সকালে ঘুম হতে উঠেই গাড়ি্তে চড়েন, বাস উঠেন, মোটর সাইকেল চালান, বিমানে করে বিদেশ পাড়ি জমান...আপনি সব অর্থে সুদের বেনিফিসিয়ারী! ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে সুদখোর আখ্যা দেয়ার আগে আয়নায় নিজের চেহারা দেখার অনুরোধ করবো।
ব্যাংকিং সিস্টেম একটি ব্যবসা। এবং সব ব্যবসার মত এ ব্যবসার উদ্দেশ্যও প্রফিট। আপনি প্রফিটকে ঘৃণা করলে আঞ্জোমানে মফিদুল ইসলামে যান, ওখানে অনেক কিছু প্রফিট বিহীন। হাত পাতেন পি কে হালদার অথবা সফেদ পীর সালমান এফ রহমানদের দুয়ারে। হয়ত তাদের কাছে ফ্রী'তে দেয়ার মত কিছু উচ্ছিষ্ট থাকতে পারে। বাকি পৃথিবীর কোথাও কেউ ফ্রীতে দেয়না!
আর যদি ব্যাংক হতে অর্থ নিয়ে নিজের ভাগ্য গড়তে চান, তাহলে আপনাকে ব্যাঙ্কিং নিয়ম মেনেই তা করতে হবে। সময় মত সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হবে। না পারলে আপনার কো-লেটারেল যাবে। এবং কো-লেটারেল যদি ঘরের চালও হয় তা নিয়ে সমালোচনার কিছু নেই। কারণ ক্ষুদ্র ঋণের কো-লেটারেলও ক্ষুদ্র। খোদ রাষ্ট্র যদি সুদ পরিশোধে ব্যার্থ হয় তা হলে সে দেউলিয়া হয়ে যায়। শ্রীলংকা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে বিভিন্ন ভাবে হেনস্তা করছেন। তা করতে গিয়ে ব্যবহার করছেন দেশের বিচার বিভাগকে। অনেকে বিচার ব্যবস্থার ইন্টিগ্রিটির কথা বলে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেন এসব প্রতারণা।
কেন এই হেনস্তা? কেন এই অসন্মান? কেন এই প্রতারণা?
অনেকের কাছে এসবের কারণ অনেক রকম।
অনেকে বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসের ভূমিকার কথা। অনেকে বলছেন তিনি নোবেল পেয়েছেন আর উনি পাননি। আর খোদ স্বৈরাচার আঙ্গুল তুলছেন পদ্মাসেতুর উষালগ্নে বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকার দিকে। কিন্তু আমার বিচারে ডক্টর মোহম্মদের 'অপরাধ'টা অন্য জায়গায়!
উপরের সব গুলো কারণে কিছু সত্যতা থাকলেও একটা কারণ আমার কাছে মুখ্য, আর তা হচ্ছে গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় এখন ডক্টর মোহম্মদের নামে। এই ভদ্রলোকের নামে বিশ্ব সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোর্স করানো হচ্ছে। মানুষ টিকেট কেটে উনার বক্তব্য শুনতে ভিড় জমাচ্ছে।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার কাছে উনার পিতা হচ্ছেন বিশ্বব্রম্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা। সকাল সূর্য উঠে বিকেলে অস্ত যায় সেটাও হয় পিতার ইশারায়।
কিন্তু হায়! শেখ মুজিব নামে দক্ষিণ এশিয়ায় একজন মহা স্বৈরাচার ছিলেন তা কেউ জানেনা। কলোম্বিয়া দেশের কার্তাজেনায় Chiva Tour যাত্রীদের জানার তো প্রশ্নই আসেনা। শেখ হাসিনার রাগ ও ক্ষোভ এখানেই। এ জন্যেই তিনি ডক্টর মোহম্মদকে হেনস্তা করছেন। প্রতিশোধ নিচ্ছেন নিজের ও পরিবারের অপ্রাপ্তির।
স্বৈরাচারদের বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই হয় ঠিকই, তবে তা ভাল কোন অধ্যায়ে না, শ্রেফ আস্তাকুড়ে। আজকে শেখ হাসিনা মারা গেলে কালকে তার সাথে তার স্বৈরাচার বাবার নামও কবরে যাবে। সাথে যাবে তার থানা পুলিশ, আইন আদালত, মিডিয়া দালাল সহ আরও অনেকে যারা আজকে ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে ধাক্কাছেন।
ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস বেঁচে থাকা অবস্থায় নিজের স্থান ইতিহাসে নির্ধারণ করে যাচ্ছেন। এ নাম স্বৈরাচারের গৃহপালিত কুকুরদের নিয়ে সাময়িক হেনস্তা করা গেলেও তা স্থায়ী হবেনা। সময়ই দেবে সবকিছুর উত্তর।
(বানান ফানান ভুল হইলে ক্ষমা কইরা দিয়েন। ব্যাকরণ লাইনে দখল খুবই দুর্বল)