বলা হতো ক্ষমতার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। শেখ হাসিনার কিছু হলে সামনে আসার জন্যে সদা প্রস্তুত ছিলেন। ছায়ার মত সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন। সরকারী কোন পদে না থাকলেও ঘুরে বেড়ানোর সব খরচ বহন করেছে রাষ্ট্র। শেখ বংশের সব চাইতে লাভবান ও ভাগ্যবান ব্যক্তি শেখ রেহানা। অনেকে বলেন প্রথমে বাপের নাম, পরে বোনের নাম ভাঙ্গিয়ে ভোগ করে গেছেন নিজের জীবন। কেউ তাতে বাধ সাধেনি। কোথাও কোন সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়নি। কন্যার বদৌলতে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করলেও ঐ দিকে খুব একটা পা বাড়াতেন না নিজের হিস্যা আদায়ের সমীকরণ মেলানোর জন্যে। সব বিচারে তিনি ছিলেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপের ভাগ্যবতীদের একজন।
বলাহয় শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনার চাইতেও ধনী। দেশে বড় বড় প্রকল্প প্রনয়নে তার আগ্রহ ছিল সবার চাইতে বেশী। বড় বোনের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির শর্ত হিসাবে তাকে দেয়া হয়েছিল আয়-রোজগারের আলাদিনের চেরাগ। লুটপাট হতে শেখ হাসিনার প্রাপ্য অংশ তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেলেও শেখ রেহানার ৫০ শতাংশ তার নিজের নামেই জমা হতো। এভাবেই গেল ১৬ বছরে গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের আলিশান সাম্রাজ্য।
শুরুটা কিন্তু এরকম ছিলনা। পিতা সহ পরিবারের বাকি সবাই নিহত হওয়ার পর অনেকটা নিঃস্ব হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে লুকিয়ে ছিলেন। ১৯৮০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সবুজ সংকেত পেয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন অনেকটা উদ্বাস্তু হয়ে।
স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিকীর হঠাৎ করেই ব্রেইন টিউমার ধরা পরে। ভাল চিকিৎসা করানোর মত অর্থ শেখ পরিবারের কারও হাতেই ছিলনা। বাধ্য হয়ে শেখ রেহানা বিত্তশালীদের দুয়ারে ধর্ণা দেয়া শুরু করেন।
সব দুয়ার হতে রিক্ত হাতে ফিরে এলেও দুঃসময়ে আশার আলো নিয়ে এগিয়ে আসেন ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান ফজলুর রহমান। এবং এখানেই শুরু হয় শেখ পরিবারের সাথে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রণয়।
আওয়ামী লীগের অন্দর মহলে সবার জানা ছিল সালমান এফ রহমান শেখ রেহানার লোক। প্রকল্পে বিনিয়োগের নামে বেক্সিমকো যে লাখ লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার একটা মোটা অংশ গেছে শেখ রেহানার পকেটে। শেখ রেহানার ব্রেইন হতেই নাকি জন্ম নিতো সরকারী সম্পদ লুটপাটের রোডম্যাপ। এসব কাজে কারিগরী সহায়তা দিতো শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। অংশিদার বনে আঠার মত লেগে থাকতেন হাসিনা কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ছিল শেখ পরিবারের অন্যতম লাভজনক প্রকল্প। লাভের মাত্রা এতটাই বেশী ছিল যার কারণে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এনার্জি খাতের লুটপাট নিয়ে জয় ও শেখ রেহানার মাঝে দ্বন্ধ দেখা দিলে সে দ্বন্ধ মেটাতে মধ্যস্থতা করতে আবারও এগিয়ে আসেন দরবেশ বাবা খ্যাত সালমান রহমান। এই খাতের দুর্নীতির কিছু প্রমাণ সাংবাদিক পরিবার সাগর-রুনির হাতে আসার কারণেই নাকি তাদের খুন করা হয়। এই কাজে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন এটিএন টিভির মালিক ও স্বঘোষিত গায়ক মাহফুজুর রহমান। এখানেও নাকি খুঁজলে শেখ রেহানার হাত পাওয়া যাবে।
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভাগাভাগি নিয়ে কথা উঠলেও এর পক্ষে এখনও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে যে অংকের কথা বলা হচ্ছে তার সামান্যতম অংশ সত্য হলে তা বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে যে কাহিনী বাজারে চালু আছে তার বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই তা অনেকেরই জানা। তারপরও শেখ হাসিনার প্রতিশোধের ভয়ে স্থানীয় প্রচার মাধ্যম ছিল নীরব। বাস্তবতা হচ্ছে প্রকল্পের শুরুতে বাকি দশটা প্রকল্পের মতই বিশ্বব্যাংকে একটা তালিকা পাঠানো হয়েছিল। এ তালিকায় এমন কজনের নাম ছিল যার আড়ালে ছিলেন শেখ পরিবারের সদস্য। এমনকি নিক্সন চৌধুরি নামের শেখ পরিবারের জনৈক রাজনীতিবিদ নিজের হিস্যার দাবি নিয়ে স্বশরীরে হাজির হয়েছিলেন বিশ্বব্যাংকের দরবারে। প্রফেসর মোহম্মদ ইউনুসকে বলি বানিয়ে ধামাচাপা দেয়া হয় শেখ পরিবারের এ কলংক।
কমিশন বাণিজ্যের কেলেংকারি প্রকাশিত হওয়ার পর পদ্মাসেতু প্রকল্প হতে কেবল বিশ্বব্যাংকই না এডিবিও সরে যায়। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত ১২০ কোটি ও এডিবির ৬১ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ছিল নাম মাত্র সুদে (০.৭০%)। সেই একই প্রকল্পের চীনা বিনিয়োগের সুদ এখন পরিশোধ করা হচ্ছে উচ্চ হারে। সবই শুরু হয়েছিল যেদিন শেখ হাসিনা দম্ভভরে সংসদে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেতুর অর্থায়নের এক বাংলাদেশই যথেষ্ট!
একটা বাস্তবতা আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, জয় ও পুতুল ওয়াজেদ গংদের লুটপাটের মূল উৎস ছিলে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ও পোশাক শিল্পের বৈদেশিক মুদ্রা। বিদেশে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে র্যামিটেন্স পাঠায় তা লুটপাটের অপর নামই হচ্ছে শেখ হাসিনার উন্নয়ন। আর এই কথিত উন্নয়নের নীরব বেনিফিসিয়ারী হচ্ছেন শেখ রেহানা। কথিত আছে গাফফার চৌধুরির প্ররোচনায় একবার শেখ রেহানা বিকল্প আওয়ামী লীগ তৈরি করে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন। বোন শেখ হাসিনা খবর পেয়ে তার দফারফা করেন ছোট বোনকে আরও অধিক আর্থিক সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা লোমহর্ষক ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাভার এলাকায় পুলিশ তাদের গুলিতে নিহত একদল আন্দোলনকারীর লাশ গ্রোসারী মালামালের মত গাড়িতে উঠাচ্ছে। এবং উঠানোর পর ঐ ভ্যানগাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার তথ্যও সামনে আসছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এসব হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের আসল বেনিফিসিয়ারী কারা ছিল। ভুলে গেলে চলবে না কাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে এমন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। নিশ্চয় শেখ হাসিনার পাশাপাশি শেখ রেহানার নামও আসবে এ তালিকায়।
হাসিনা গংদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত না করা গেলে বাংলাদেশের ইতিহাস কোনদিনও সম্পূর্ণ হবেনা।