এই লেখাটার মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে হাতে সময় থাকলে চলুন কিছুটা সময় ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে ব্যায় করি। ১৯৯২ সালে হয়ত পাঠকদের অনেকের হয়ত জন্মই হয়নি। অন্তত কিছু বিষয়ের সাথে সচেতন পাঠকের পরিচিত হওয়াটা খুবই জরুরি।
একই সালের ৩রা এপ্রিল মধ্য ইউরোপে দেশ যুগোস্লাভিয়ায় গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। এক বছর আগে ১৯৯১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে কেবল। ইউনিয়ন হতে বেরিয়ে গিয়ে বাকি ১৪টি প্রজাতন্ত্র আলাদা দেশ হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। এই পতনের প্রভাব ফেলতে শুরু করে পূর্ব ইউরোপের সবকটা দেশে।
যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রীয় কাঠামো সোভিয়েত কাঠামোর সাথে অনেকটাই মিল ছিল। সার্বিয়া, বসনিয়া হারজোগভিনা, উত্তর মেসিডোনিয়া, মন্টেনিগ্রো, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভানিয়া এবং আংশিকভাবে স্বীকৃত কসোভা নিয়ে গঠিত হয়েছিল যুগোশ্লাভ ফেডারেশন।
বর্তমান রাশিয়ার মত loosing end'এ ছিল অধুনা সার্বিয়া। সার্বিয়ার লৌহ বলয় হতে বেরিয়ে গিয়ে একে একে বাকি ৬টি ফেডারেশন স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। স্বভাবতই সার্বিয়ান নেতৃত্ব সহজে হজম করতে পারেনি নিজেদের এ দুর্দশা।
সোভিয়েত ও যুগোশ্লাভ পতনের একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল; সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ধ্বসে যাওয়ার পর রাশিয়া এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি। অন্যদিকের স্লোভোদান মিলোশভিচের নেতৃত্বে সার্বিয়ান সরকার হজম করতে পারেনি নিজেদের পরাজয়।
ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়ায় পুতুল সরকার বসিয়ে তাদের সাহায্যের নামে নিজেদের সৈন্য পাঠায় সার্বিয়া। কসোভার স্বাধীনতা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি তারা। শুরু হয় অল-আউট গৃহযুদ্ধ। শক্তিমান সার্বিয়া রুশদের সমর্থন নিয়ে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। এই যজ্ঞের মূল শিকার হয়ে দাঁড়ায় মুসলিম অধ্যুষিত বসনিয়া হার্জেগোভিনা ও কসোভা।
রাদোভান কারাদিচ পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার। যুগোশ্লাভ ফেডারেশন হতে বেরিয়ে গিয়ে বসনিয়া হার্জেগোভিনা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সে অঞ্চলের সার্বরা নাম লেখায় সংখ্যালঘুর তালিকায়। কারাদিচ মেনে নিতে পারেননি এ বাস্তবতা। প্রতিশোধ নিতে গঠন করে সার্ব ডেমোক্রেটিক পার্টি। এবং দেশটার সার্ব অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠন করেন নতুন দেশ Republika Srpska। নিজকে দেশটার প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা দেন। এবং গোটা বসনিয়ায় সার্বদের আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্য শুরু করেন গণহত্যা। এ কাজে তার ডানহাত হিসাবে যোগ দেন জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ। স্বাভবতই সীমান্তের ওপার হতে সমর্থন পান সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলশোভিচের।
সেব্রেনিতসিয়া। বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলিম অধ্যুষিত একটি গ্রাম। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে এ গ্রামে হাজির হয় কারাদিচ-ম্লা্দিচ সেনারা।
আগমনের প্রথম প্রহরে গ্রামের পুরুষদের আলাদা করে ফেলে বাকি জনসংখ্যা হতে । পুরুষ তালিকা হতে রেহাই দেয়া হয়নি বালকদেরও। ৮ হাজার পুরুষ ও বালকদের বন্দুকের নলের মুখে বাধ্য করে তাদের নিজেদের কবর খুড়তে। কবর খোরা শেষ হলে ব্রাশ ফায়ার করে সবাই হত্যা করে। এবং মাটি চাপা দিয়ে চলে যায় অন্যদের সন্ধানে।
আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনীর হস্তক্ষেপে যুদ্ধের অবসান ঘটে ১৯৯৫ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। পরাজিত হয় Republika Srpska'র সার্ব বাহিনী। কারাদিচ-ম্লাদিচ চক্র পালিয়ে আশ্রয় নেয় সার্বিয়ার মূল ভূখণ্ডে। তাদের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের অন্যতম আর্কিটেক্ট স্লোভোদান মিলোশোভিচ লুফে নেয় এই কসাইদের।
সেব্রেনেতসিয়ায় ঘটে যাওয়া গণহত্যার নির্মমতা সামনে আসতে থাকে একে একে। গোটা বিশ্ব শিউরে উঠে হত্যাযজ্ঞের নির্মমতার বিস্তারিত জেনে। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হয় মিলোশভিচ, কারাদিচ ও ম্লাদিচের বিরুদ্ধে। ওদের সবাইকে গ্রেফতার করে ভরা হয় আন্তর্জাতিক জেলে। শুরু হয় বিচার পর্ব।
নেদারল্যান্ডের হেগ আদালতে বিচার চলাকালীন সময় হার্ট এটাকে মারা যান এক সময়ের সার্বিয়ান লৌহমানব স্লোভোদান মিলোশভিচ। Republika Srpska'র স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট রাদোভান কারাদিচ ও তার পার্টনার ইন ক্রাইম জেনারেল রাতকো ম্লাদিচকে দেয়া হয় যাবত জীবন কারাদণ্ড।
এবার আসি লেখার মূল প্রসঙ্গে।
জুলাই মাসের অগ্নিঝরা দিনগুলোর একদিন বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা গণভবনে বসে তার দোসরদের আহবান জানিয়েছিলেন যার যা কিছু আছে তা নিয়ে রাস্তার আন্দোলনকারীদের মোকাবেলা করার জন্যে।
আশাহত করেনি স্বৈরাচারের দোসররা। ওরা মাঠে ঘাটে পশুর মত মানুষ হত্যা করেছিল। এবং স্বপক্ষে সাক্ষী হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে অসংখ্য প্রমাণাদি। সাভারের কোথাও ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড ও এর ভিডিও তার চাক্ষুষ প্রমাণ।
শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করার জন্যে তার নিজের করা ভিডিওতে যার যা আছে তা নিয়ে তৈরি থাকার ডাক এবং এর পরপর সাভার গণহত্যা ও তার ভিডিও এভিডেন্স হেগ আদালতে বিচার ও শাস্তির জন্যে যথেষ্ট বলেই বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান ইন্টেরিম সরকার কাজটা করবে কিনা জানিনা, তবে সামনে নির্বাচিত কোন সরকার চাইলে শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক আদালতে হাজির করতে পারবে। ঐ আদলতে শাস্তিযোগ্য অপরাধের একাধিক প্রমাণ থাকবে তাদের হাতে।