আপনার কি ইদানিংকালের ঢাকা শহরকে কাছ হতে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে? প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করলে বোধহয় সহজ হবে, কতদিন হল দেশে যান্নি? সময়টা খুব একটা লম্বা না হলে আমার লেখটা পড়ে মজা পাবেন্না। পাঠক, আপনি নানাহ কারণে অনেকদিন দেশে যেতে পারেন্নি, প্রিয় জন্মভূমির রাজধানী ঢাকাকে দেখেন্নি তাও প্রায় অনেকগুলো বছর। একটু নড়ে চড়ে বসুন, আপনাকে ঢাকা নিয়ে যাচ্ছি আমি, মেগা শহরের দু’একটা অলিগলির সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেব। বিনিময়ে কিছুই চাওয়ার নেই আমার, মূল্য আপনার একটু অবসর সময়।
ঢাকা! এমন একটা নামের উৎস, মহাত্ম এবং বৈশিষ্ট কি, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার কখনোই প্রয়োজন বোধ করিনি, কারণ জন্ম হতেই ঢাকাকে দেখছি নিজের করে। দেখছি জরাজীর্ন একটা শহর ফুলে ফেপে বিস্ফোরিত হয়ে মেগা সিটিতে রূপান্তরিত হতে। জিয়া বিমান বন্দরে ৫০ ডলার নগদ দিয়ে ১ মাসের আগমনী ভিসা নিতে ইমিগ্রেশনের আন্তরিকতায় মুগ্ব না হয়ে পারলামনা। এয়ারপোর্ট টাকেও আগের চেয়ে বেশ ঝকঝকে মনে হল, নতুন একটা টার্মিনাল যোগ হয়েছে, ভেতরে টাউট বাটপারদের আনাগোনাও মনে হল বেশ নিয়ন্ত্রিত। এক কথায়, প্রাথমিক ইমপ্রেশটা মনে রাখার মত (পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে)। কাস্টমস্ পার হলাম বিনা প্রশ্নে, সবাই স্যার স্যার বলে ব্যতিব্যস্ত করে তোলায় একটু ঘাবড়ে গেলাম, আমি কি আদৌ বাংলাদেশে! আমার এক ভাই এসেছে নিতে, চারদিকে এত তোষামদির কারণ জিজ্ঞেষ করতে জানা গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর বিমান বন্দরের কর্মচারী কর্মকর্তারা সবাই ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে, কখন আবার ঝোলার বেড়াল বেরিয়ে পরে। আমি প্রায় ভূলেই গিয়েছিলাম, দেশে এখনো জরুরী অবস্থা। সব ঝামেলা চুকিয়ে বিমান বন্দর হতে বের হতেই চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ল সেই পরিচিত ঢাকা!
হাজার হাজার মানুষ, ততোধিক যানবাহন। বিমান বন্দরের নিয়ন আলো ধূলার সমুদ্রে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে ভূতুরে এক পরিবেশ তৈরী করছে, যার উপর ঘন কুয়াশার চাদর শার্লক হোমস্’এর মার্ডার মিস্ট্রির পরবেশকেই যেন মনে করিয়ে দেয়। চারদিকে চোখ বুলাতে হরেক রকম যানবহনের মিছিল দেখে অবাক না হয়ে পারা যায়না; লক্কর ঝক্কর হলুদ ক্যাব, তিন চাকার মিশুক, হাড্ডির প্রদশর্নীতে ঝমঝমাট চার চাকার কথিত মিনি বাস, এক কথায় এলাহি আয়োজন। এবং সবই আমার মত প্রবাসীদের জন্য। বলিভিয়ার লা পাস এয়ারপোর্টের দৃশ্যটা মনে না করে পারলামনা, আমাদের চেয়েও গরীব দেশ, র্দুনীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তবু কোথায় যেন ছন্দের সূর, জীবনের হাতছানি! কাচের বাইরে ঢাকা শহরে মনে হল সবই আছে, কিন্তূ কেমন যেন এলোমেলো, বেসূরা।
ঘড়িরা কাটা প্রায় দশটা ছুই ছুই করছে, ফার্মগেটের কাছাকাছি আসতেই রক্ত হীম হয়ে গেল, বিশৃখংলার সমুদ্র, হাজার নয় মনে হল লাখ খানেক যানবানহন এলোপাথারি ভাবে স্তব্দ হয়ে আছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ৭০ দশকে দেখা ঢাকাকে মনে করার চেষ্টা করলাম, পাশাপাশি ২০ বছর পর ঢাকার একটা চিত্র আকার চেষ্টা করলারম। এ অংক মেলাবার নয়, কোথায় যেন কি একটা কাজ করছেনা, নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে হল। শেষমেস ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিলাম এসব লাগামহীন ভাবনা, মায়া হল শহরটার জন্যে, দুঃখ হল এর কোটি বাসিন্দার জন্যে।
বাসায় ফিরতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেল, মোবাইল ফোনের কারণে আমাদের প্রতি মিনিটের অবস্থান মনিটর হচ্ছিল বাসা হতে। যে ড্রাইভারকে সারাজীবন টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে হয়েছে তার হাতের মোবাইল বেজে উঠতেই যেন ঘুম হতে জেগে উঠলাম, আসলে বোধহয় জীবন অতটা ছন্দহীন নয় যতটা আমি ভাবছিলাম।
সপ্তাহখানেক পরেই নির্বাচন; কেমন যেন অপরিচিত মনে হল নির্বাচনী বাতাস, রাতের স্তব্দতা ফুড়ে নেই কোন মিছিলের গর্জন, রাস্তায় নেই রঙিন ব্যানার আর ফেষ্টুনের মেলা। জরুরী অবস্থা আর সেনা সমর্থিত সরকারের প্রেতাত্মা যেন টহল দিচ্ছে নির্বাচনী বাতাসে। সাদাকালো পোস্টারগুলোতে অপরিচিত নাম দেখে অবাক হলাম, ১/১১’র ছোয়া কিছুটা হলেও লেগেছে এবারের নির্বাচনী বানিজ্যে। বিছানায় যেতে অনেক রাত হয়ে গেল, লম্বা জার্নি শেষে নিজকে একেবারেই বিধ্বস্ত মনে হল, নিউ মেক্সিকো অংগরাজ্যের আলবাকুরকে শহরটা মনে হল কল্পরাজ্যের কোন স্বপ্নের শহর। ঘুম এলনা ভিন্ন টাইম জোনের কারণে, জানালার পর্দাটা সড়িয়ে মধ্যরাতের ঢাকাকে দেখার চেষ্টা করলাম। কুয়াশায় সম্পূর্ণ ডুবে গেছে শহরটা, এত রাতেও টুং টাং করে চলছে দু’একটা রিক্সা, মাঝে মধ্যে ভারি ট্রাকের গর্জনে কেপে উঠছে ধানমন্ডির এই পাশটা। শহর নয়, হঠাৎ করেই আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম; বাল্য আর যৌবনের হাজার সৃত্মি সেলুলয়েডের পর্দার মত ভেসে উঠল মনের কোঠায়! প্রথম ভালবাসা, প্রথম সেক্স, প্রথম চাকরী, সাফল্য, ব্যর্থতা, বাবা মার মৃত্যু , - সব কিছুই হয়েছে এই ঢাকা শহরে। পাঁচ বছর দেখিনি শহরটাকে, মনে হলে পাঁচটা বছর আমার মা-বাবাকে দেখা হয়নি। এ শহরের সমস্যা অনেক, কষ্ট হাজারো, এ শহরের জীবন মানবেতর, কিন্তূ সব কিছুর পরেও এই আমার শহর, এখানেই আমি মানুষ, এখানেই শুয়ে আছে আমার মা-বাবা। হঠাৎ করেই সেই পরিচিত ঢাকাকে খুজে পেলাম, মনটা কিছুটা হলেও হাল্কা হয়ে গেল। সকালে সামনের ক্যালিফোর্নিয়া নামের ভয়াবহ নোংরা হোটেলটায় নাস্তা করতে যাব, ভাবতেই ভাল লাগল। কারণ আমি ঢাকাকে দেখব খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের চোখে, ক’টা দিনের জন্যে হলেও উপভোগ করব তাদের জীবন। এলিয়ে পরলাম বিছানায়, রাজ্যের ক্লান্তি এসে টেনে নিল ঘুমের রাজ্যে।