সিডনী ছেড়ে সবেমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছি। আশ্রয় নিয়েছি প্যান্সেলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়া শহরে। শিহাব আমার নেংটা কালের বন্ধু, মাঝখানে ২০ বছর যোগাযোগ না থাকালেও পূনঃমিলনে আন্তরিকতার কোন অভাব দেখলাম না। দু’দিনের ভেতর পরিবারের বাকি সবার কাছেও প্রিয়জনদের একজন হয়ে যাওয়ায় প্রবাসের এ অংশটা বেশ ভাল ভাবেই শুরু হল। সমস্যাটা দেখাদিল অন্য জায়গায়, অষ্ট্রেলিয়ার সাথে সময় এবং ঋতুর বৈপরিত্যের কারণে আমি কিছুতেই সময় দিতে পারছিলামনা পরিবারের সাথে। সবাই যখন ঘুমায় আমি তখন ঘুমহারা নিশাচর পাখী, আর দিনের আলোর দৈনন্দিন জীবন আমার জন্যে নিয়ে আসে রাজ্যের ঘুম। দু’সপ্তাহ হয়ে গেল এমনটা চলছে, বন্ধুর চোখেও দেখলাম বিরক্তি।
খুব সকাল বেলার কথা, নিদ্রাহীন রাতের শেষে ঘুমের আয়োজন করছি কেবল। বাসার মূল ফটকের ঘন্টাটা প্রচন্ড শব্দে বেজে উঠল। যেহেতু দরজার সবচেয়ে কাছের রুমটা আমার তাই আমাকেই খুলতে হল রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে। অত্যন্ত সুগঠিত শরীরের এক স্বদেশী। হাটুর কব্জী পর্য্যন্ত উঠানো পাজামা, পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী এবং মুখে ঘন কালো দাড়ি। ‘আস্সলামুয়ালাইলুম’। সালামের প্রতিউত্তর দিয়ে জানতে চাইলাম আগমনের হেতু। দু’এক কথা শেষে জানা গেল শিহাবকে ফজরের নামাজে নিতে এসেছেন ভদ্রলোক। গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধুকে দেখা যাচ্ছেনা মসজিদে তাই নিয়ে যাওয়ার এই আয়োজন। বৈঠকখানায় বসতে দিয়ে ভেতরে যাওয়ার আয়োজন করতেই জানতে চাইলেন আমার পরিচয়। নিজের পরিচয় অর্ধেক বর্ণনার আগেই বলে ফেল্লেন আপনিও তৈরী হয়ে নিন, মসজিদে যেতে হবে। কোন কথা না বলে ভেতরে গেলাম শিহাবের খোজে। তাকে সংবাদটা পৌছে দিয়ে ঝাপিয়ে পরলাম বিছানায়। শিহাব ফিরে এল আমার খোজে, ঘুম কাতর চোখে জানিয়ে দিলাম যাচ্ছিনা মসজিদে।
খবরটা লু হাওয়ার মত হু হু করে রটে গেল, ফিলাডেলফিয়ায় এমন একজন বাংলাদেশী এসেছে যে কিনা মসজিদে যাওয়ার দাওয়াৎ ফিরিয়ে দিয়েছে! বিকেলে ভদ্রলোক আবার ফিরে এলেন, সাথে একজন ’বুজুর্গ’ ব্যক্তি। নতুন জন স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি এবং এ শহরের বিশিষ্ট বাংলাদেশী। নাছোড় বান্দা, আমাকে এশার নামাজে যেতে হবে। আবারও কথা এড়িয়ে শিহাবকে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলাম নিজ রুমে। কিন্তূ এ যাত্রায় পার পাওয়া গেলনা, শিহাব এসে জানাল তারা কথা বলতে এসেছে আমার সাথে। এ সব উটকো ঝামেলার সাথে অনেকদিনের পরিচয়, মোকাবেলার রাস্তাও জানা। গেলাম কথা বলতে। যা আশা করছিলাম তাই হল, বয়ানের সূনামীতে আমাকে সমাহিত করার চেষ্টা চল্ল অনেকক্ষন। শেষ পর্য্যন্ত মূখ খুল্লাম, ’ভাই আপনারা এসেছেন তার জন্যে হাজার শুকরিয়া, কিন্তূ ধর্মকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে নিতে অভ্যস্ত এবং কখন ও কোথায় এর চর্চা করব তার সিন্দান্তও আমার নিজের। দোয়া করবেন সৃষ্টিকর্তা যেন আমাকে সঠিক পথে চালিত করেন’। লম্বা একটা সালাম দিয়ে বিদায় নিলাম। চারদিকে আমার নামে ঢি ঢি পরে গেল।
সময়ের কুটজাল হতে বেরুতে আরও ১৫ দিন লেগে গেল। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম নতুন টাইম জোনে। এক দুপুরে ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয়। শিহাবদের প্রতিবেশী এবং যিনি দাওয়াৎ নিয়ে এসেছিলেন উনার স্ত্রী। দু’দশক ধরে আছেন এ দেশে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের মাষ্টার্স । প্রায়ই আসেন এখানটায়, আলাপ করতে গিয়ে অনেকটা বন্ধুর মত হয়ে গেলাম। মাঝখানে ক’টা দিন দেখতে না পেয়ে বন্ধুর স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম জয়তি ভাবির কথা। উত্তরে যা শুনলাম তাতে আমি থ! জয়তি ভাবিকে নিয়মিত পিটিয়ে থাকেন উনার অতি ধার্মিক স্বামী, এবং এ পেটানোতে প্রায়ই অংশ নেয় এ দেশে জন্ম নেয়া ভাবির ১৩ বছরের ছেলে। বাবা এবং ছেলে মিলে প্রায়ই ভাবিকে আধমরা বানায়, পশু শক্তিতে প্রতিশোধ নেয় হাজার অভিযোগের। প্রতিবেশীদের অভিযোগের কারণে বেশ ক’বার পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে পরিবারের সবাইকে। কিন্তূ তাতেও থামেনি দ্বিতীয় শ্রেনী ফেল বশির মিয়ার পাশবিক অত্যাচার। বাংলাদেশে ভাবির আপন বলতে কেউ নেই, সৎ ভাই-বোনদের মাঝে মানুষ, বাবা থেকেও নেই। বশির মিয়া মিথ্যার ফাদে ফেলে জয়তি ভাবীকে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে ভাবী জানতেন উনার হবু স্বামী উচ্চ শিক্ষিত এবং ভাল একটা চাকরী করছে আমেরিকায়। জারি জুরি ধরা পরে যায় জেএফকে এয়ারপোর্টে নেমে, বশীর মিয়াকে ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরন করতে সাহায্য নিতে হয় সহযাত্রীর। স্থানীয় একটা মলে ট্রলিতে আতর বিক্রী করেন বশীর মিয়া, লেখাপড়া দ্বিতীয় শ্রেনী পর্য্যন্ত। শিহাবের স্ত্রী জানাল জয়তি ভাবিকে গতকাল পেটানো হয়েছে আমার সাথে কথা বলার কারণে। দুঃখ হল মানুষটার জন্যে। কিন্তূ বাস্তবতার বিচারে ভাবির সান্নিধ্য হতে দূরে থাকার সিদ্বান্ত নিতে বাধ্য হলাম। দু’মাস পর কোন এক সুন্দর সকালে অনেকটা নীরবে ছেড়ে গেলাম ফিলাডেলফিয়া। জয়তি ভাবির সাথে আর কোন দিন দেখা হয়নি।
নিউ ইয়র্কের বেসমেন্টের রুমটায় বসে স্থানীয় খবর দেখছিলাম। একটা খবর দেখে পিলে চমকে উঠল। ফিলাডেলফিয়ায় অতিবৃষ্টির কারণে কোন এক বাংলাদেশীর বেসমেন্ট পানিতে তলিয়ে যায়। পানি হতে প্রায় মৃতাবস্থায় উদ্বার করা হয় গৃহকর্ত্রীকে, যার হাত পা ছিল দড়িতে বাধা। এখানেই কাহিনীর শেষ নয়, পানির তোড়ে ভেসে উঠে প্রায় লাখ খানেক ডলার এবং আবিস্কৃত হয় বেসমেন্টের অবৈধ আতর কারখানা। শিহাবকে ফোন করে জানা গেল জয়তি ভাবি এবং বশীর মিয়াদের শেষ পরিনতি। হ্যা, ঘটনা ঘটেছিল তাদেরকে ঘিরেই।
আমার এ লেখাটার দু’টো উদ্দেশ্যঃ এক; অতি উৎসাহি ধার্মিকদের বলব, অন্যকে ধর্ম পালনে টানাটানির আগে নিজের সবকিছু যাচাই করে দেখুন। ও ফ্রন্টে সবকিছু কি ধর্মীয় অনুশাসনে চালিত হচ্ছে? দুই; আমেরিকার নাম শুনেই পাত্রীকে গছিয়ে দেবেন না, কারণ বশীর মিয়া শুধূ একজন নন, এদের সংখ্যা হাজার হাজার।
দ্রষ্টব্যঃ শিহাব, জয়তি এবং বশীর নামগুলি কাল্পনিক।