১৯৯০ সালঃ
মিরপুর রোড এবং ধানমন্ডি পুরানো ২নাম্বার রোডের কোনায় আমার অফিসটা। জীবনের প্রথম চাক্রী। সময় নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুসরৎ ছিলনা। এলাহী কাজের ঝামেলা, সকাল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা হয়ে যেত টের পেতাম না। সামনে একটা টেন্ডার, কাজটা না পেলে কোম্পানীর অস্তিত্ব নিয়ে টান দেবে। বাংলাদেশে কম্পোটারাইজড্ টাইপিং কেবল চালু হচ্ছে তখন। প্রবাসী অভিজ্ঞতার কারণে এত বড় একটা অফিসে দেখা গেল একমাত্র আমিই এ ধরনের টাইপিংএ কিছুটা অভিজ্ঞ। বিড প্রেজেন্টেশন ছিল কাজ পাওয়ার একটা বড় ফ্যাক্টর, তাই অফিসের বিগ বস অনেকভাবে অনুরোধ করলেন টাইপিং দিয়ে সহায়তা করতে। কাক ডাকা ভোরে অফিসে যাই, বাসায় ফিরতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। এ ভাবে চলল্ দশ দিন। প্রকৌশলগীরি ছিকেয় উঠিয়ে দস্তূরমত টাইপিষ্ট বনে গেলাম। এ জন্যে একজন জুনিয়র প্রকৌশলী হিসাবে অফিস হতে যা দেয়া হত তাও ছিল বেশ ঈর্ষনীয়। যাই হোক, লেখাটার উদ্দেশ্য এটা নয়। আসছি সে প্রসংগে।
টেন্ডার জমা দেয়ার আগের রাতে বাড়ি ফেরা হয়নি, অফিসেই কাটাতে হল টুকিটাকি ঝামেলা শেষে টেন্ডারটাকে বই আকারে নিয়ে আসতে গিয়ে। যখন বের হলাম সকাল ৬টা হবে হয়ত। সকালের ঢাকাকে অনেকদিন দেখা হয়নি, তাই ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে রিক্সায় চেপে বসলাম। রিক্সা চেপে শহর দেখায় অন্য এক ধরনের মাদকতা আছে, যারা দেখেন্নি তাদের পক্ষে বুঝা হয়ত সহজ হবেনা। এলিফেন্ট রোড, শাহবাগ মোড় এবং রমণা পার্ক হয়ে যাব কাকরাইল মোড়ে। পৌষের হালকা বাতাস, সাথে মেগা শহরের ভৌতিক শূন্যতা, এ এক অনন্য দৃশ্য।
শাহবাগ মোড় পার হয়ে ঢাকা ক্লাবের কাছে আসতেই চোখে পরল লোকটাকে। বয়স অন্তত ৬০/৬৫, শুভ্র দাড়ি এবং পরনে সফেদ পাজামা পাঞ্জাবী। অন্ধ এবং হাতে একটা লাঠি নিয়ে এলোপাথাড়ি হাটছে। এক বছর আগে বাবাকে হারিয়েছি, চেহারা এবং পোশাকে কোথা যেন বাবার ছায়া দেখতে পেলাম। রিক্সাওয়ালাকে থামতে বল্লাম। প্রশ্ন করে জানতে পারলাম কমলাপুর ষ্টেশন যাবেন, হাতে পয়সা নেই তাই হাটতে হচ্ছে। অনেকটা জোর করলেই রিক্সায় উঠালাম, তা ছাড়া আমার গন্তব্যও ছিল ও দিকটায়। অনেক কথা হল ভদ্রলোকের সাথে; ছেলের বাসা ধানমন্ডি ১৫ নাম্বারে, শান্তাহার হতে ছেলের কাছে এসেছিলেন চিকিৎসা করাবেন বলে। ছেলেবৌ দরজা খুলে শ্বশুরকে দেখেই বন্ধ করে দিয়েছে, তাই রাতটা কাটাতে হয়েছে স্থানীয় একটা মসজিদে। নাস্তা দূরে থাক রাতেও খাওয়া হয়নি কিছু। হূদয় ভাংগানো কাহিনী, অতি কষ্টে চোখের পানি আটকে রাখলাম।
অনেকদিন ভাল কিছু করা হয়নি, তাই ভদ্রলোক্কে যতটুকু সম্ভব তাই করব বলে ঠিক করলাম। কাকরাইল মোড়ে বাসা পার হয়ে রিক্সা নিয়ে কমলাপুর ষ্টেশন পর্য্যন্ত চলে গেলাম। ভদ্রলোক, আমি এবং রিক্সাওয়ালা, তিনজন মিলে পেটপুরে নাস্তা করলাম, গরম চা দিয়ে সমাপ্তি টানলাম এ পর্বের। ফেরার আগে হাতে ১০০ টাকার পাঁচটা নোট ধরিয়ে নিরাপদে শান্তাহার পৌছা কামনা করে বিদায় দিলাম পিতৃতূল্য মানুষটাকে। ফেরার পথে নিজকে হালকা লাগল, অনেকদিন পর ভাল একটা কাজ করতে পেরেছি বলে বেচে থাকা ধন্য মনে হল। বাসার সামনে এসে রিক্সাওয়ালা করে বসল অবাক এক কান্ড, সে কিছুতেই ভাড়া নেবে না। দু’পা জড়িয়ে হাউ মাউ করে কেদে মাফ চাইল, জানাল সেও ভাগ বসাতে চায় এমন একটা সৎ কাজে। হঠাৎ করেই কেন জানি পৃথিবীটাকে খুব বেশী ভাল মনে হল।
অন্য একদিন। নিয়মিত অফিস শেষে বিকাল ৫টায় একই পথে বাসায় ফিরছি, এবং রিক্সায়। শাহবাগ মোড়ে আসতেই কথা নেই বার্তা নেই হুট করে এক ভদ্রলোক আমার রিক্সায় চড়ে বসলেন। শুভ্র দাড়ি, পরনে সফেদ পোশাক। ’আমাকে চট্টগ্রাম যেতে হবে, ছেলে হাসপাতালে মরি মরি অবস্থায়, হাতে যথেষ্ট টাকা নেই, দয়া করে কমলাপুর ষ্টেশন পর্য্যন্ত পৌছে দেবে বাবা?‘ সেই একই মানুষ, একই পোশাক এবং চেহারায় একই বিষন্নতা। এ যাত্রায় তিনি আর অন্ধ নন। গোখরা সাপ দেখলেও বোধহয় আমি এতটা চমকে উঠতাম না। এও কি সম্ভব! ক’সেকেন্ড মুখে কথা ফুটলনা। ’চাচা, এই আপনাকে না ক’দিন আগে ৫শত টাকা দিয়ে কমলাপুর ষ্টেশন পর্য্যন্ত পৌছে দিয়েছিলাম?’ এক সেকেন্ডও সময় দিল না আমায়, রিক্সা হতে নেমে পরি মরি করে দৌড়ে হারিয়ে গেল মানুষের ভীড়ে। থ হয়ে রইলাম অনেকক্ষন।
আমার এসব পাগলামী শুনে মাঝে মধ্যে মা বল্তেন, ’তুই অনেক ব্যাপারে পন্ডিত হলেও মানুষ চেনায় এখনো একেবারে অ আ‘। হবে হয়ত, কিন্তূ কেউ যদি মৃত বাবার চেহারা নিয়ে সামনে এসে হাত বাড়ায় সে হাত ফিরিয়ে দেই কোন সাহষে!
পুনশ্চঃ সেই কোমল মনের রিক্সাওয়ালা প্রায় এক বছর বাসা হতে আমাকে অফিস পর্য্যন্ত নিয়ে যেত। আর সেই টেন্ডারের কাজটা অফিস পায়নি ট্রাফিক জ্যামে আটকে সময় মত জমা করতে পারেনি বল।