ইংল্যান্ডে এত গরম আগে কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারলামনা। মধ্য জুন এবং তাপমাত্রা প্রায় ২৮ ডিগ্রী সেঃ, হিউমিড। সুদূর সোভিয়েত দেশ হতে দু’দিন তিন রাতের ট্রেন জার্নি শেষে যেদিন লন্ডনের লিভারপুল ষ্টেশনে পৌছলাম পূর্ব ইউরোপের হাল্কা আবহাওয়ার কোন ছায়া খুজে পেলাম না। এর আগেও বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জে অনেকবার এসেছি, গ্রীষ্মের শুরুটা এমন উত্তপ্ত হতে পারে ধারণা করতে পারিনি। ভাল আবহাওয়ার কারণে লন্ডন শহর ইতিমধ্যে ট্যুরিষ্টে ভরে গেছে; ট্রাফলগার স্ক্যয়ার, অক্সফোর্ড ষ্ট্রীট, পিকাডেলী সার্কাস সহ দর্শনীয় জায়গাগুলোতে হরেক রকম মানুষের মিছিল। সামার যব করতে মূলত এ দেশে আসা, ইচ্ছা থাকলেও আড্ডা মেরে সময় নষ্ট করার কোন উপায় ছিলনা। পূর্ব লন্ডনের প্ল্যাইষ্টো এলাকায় বন্ধুর বাসায় দু’টা দিন কাটিয়ে রওয়ানা দিলাম ডেভন কাউন্টির টর্কি শহরের দিকে।
আমার মত রহস্য উপন্যাসের ভক্ত যারা তাদের কাছে বৃটিশ লেখিকা আগাথা কৃষ্টির নামটা অপরিচিত থাকার কথা নয়। টর্কি শহরেই বাস করতেন এই লেখিকা এবং এখানে বসেই লিখেছিলেন ভূবনখ্যাত বহু উপন্যাস। ইংলিশ রিভিয়েরার টরবে উপকুল ঘিরে শহরটার মূল আকর্ষন এর বীচ। হাজার হাজার পর্যটকের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে গ্রীষ্মকালটা। এ যাত্রায়ও এর কোন ব্যতিক্রম দেখলাম না। ব্যতিক্রম একটা চোখে পড়ল অবশ্য, বীচে টপলেস মহিলা পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে প্রতি বছর। ’টেষ্ট অব ইন্ডিয়া’ নামে ভিক্টোরিয়া প্যারেডের উপর বাংলাদেশী একটা রেষ্টুরেন্টই হল আমার ঠিকানা। আমার দু’বন্ধু ইতিমধ্যে এখানটায় কাজ করছিল, তাই কাজ পেতে বিশেষ কোন অসূবিধা হলনা। যদিও বিলাতের বিলিয়ন পাউন্ডের এই রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশী সিলেটিরা, কিন্তূ ঐতিহাসিক কারণে এর পরিচিতি ভারতীয় হিসাবে। ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট হিসাবেই বৃটিশদের কাছে এর সমাদর।
দুপুর ১২টা হতে বিকাল ৩টা, এবং সন্ধ্যা ৬টা হতে মধ্যরাত পর্য্যন্ত রেষ্টুরেন্ট খোলা। উইক এন্ড’এ অনেক সময় মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায় তবুও রেষ্টুরেন্টের দুয়ার বন্ধ হয়না। এ শহরে যে কোন ব্যবসাই মূলত গ্রীষ্মকালের ৩ মাসের জন্যে, বছরের বাকি সময়টা কোন রকম টেনে টুনে মালিককে চালিয়ে নিতে হয়। সংগত কারণেই সামারে যতটা সম্ভব ব্যবসা করতে বাধ্য হয় বাকি সময়ের কথা ভেবে। যেখানটায় কাজ করছি তার ডানে-বায়ে অনেক নাইট ক্লাব এবং ক্যাসিনো। রাত ১২টার পর হতে জমতে শুরু করে রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা। ওরা আসে দল বেধে, মাতাল এবং হিংস্র। অনেক সময় ভীড়ের ফাক গলে পালিয়ে যায় পয়সা না দিয়ে। ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌছে গিয়েও শুধু ক’টা পাউন্ডের জন্যে দাতে দাত কামড়ে কাজ করতে হয় বিনা প্রতিবাদে। দু’টা সপ্তাহ না যেতেই ঘন ঘন চোখ বুলাতে হয় ক্যালেন্ডারের পাতায়, অপেক্ষায় থাকি কখন শেষ হবে এই শারীরিক এবং মানষিক যন্ত্রণা।
বাংলাদেশের সেরা গায়ক কে এ নিয়ে লাঞ্চ ব্রেকে তর্ক বেধে গেল রেষ্টুরেন্টে কর্মরত সিলেটী ভাইদের সাথে। আমরা কেউ বল্লাম মাহমুদুন্নবী, কেউ মোঃ আবদুল জাব্বার, কেউ আবার আবদুল আলীমের নাম। সিলেটী ভাইদের সন্তূষ্ট করা গেলনা। ওদের সবাই এক বাক্যে বল্ল ক্বারী আমিরুদ্দিনের নাম। এমন নাম বাপ জনমেও শুনেছি বলে মনে হলনা, বল্তেই হায় হায় করে উঠল সবাই। এরপর প্রতিদিন বিরামহীন ভাবে শুনতে হয়েছে আমিরুদ্দিনের গান, শুনতে হয়েছে সিলেটের পথে-প্রান্েত কতটা জনপ্রিয় এই গায়ক। আমার জানা ছিলনা লন্ডনের আলবার্ট হলে এই গায়কের কনসার্টের টিকেট ৬ মাস আগেই বিক্রী হয়ে যায়, বিলাতে বসবাসরত আধূনিক সিলেটি তরুনীদের অনেকেই শরীরে টাট্টু করে রাখে এই গায়কের নাম। অনেক বছর পর সমকালীন গায়ক হাবিবের কণ্ঠে আমিরুদ্দিনের গান শুনে (আমার কি সূখে যায় দিন রজনী কেউ জানে না, ইত্যাদী) স্মৃতির পাতা হাতড়ে ফিরে যেতে হয়েছিল টর্কির সে দিনগুলোতে।
শুক্রবার রাত যেন আর শেষ হতে চায়না। স্থানীয় ডিস্কোর আসর ভাংগতেই হুরমূর করে আসা শুরু হল কাষ্টমারদের। আমরা যারা সামনে ওয়েটিং করছি তাদের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। উগ্র স্কীনহেডের একদল এসেই শুরু করেদিল হৈ চৈ, এখনই খাবার চাই। বেহেড মাতাল এই দলের উদ্দেশ্যই ছিল হাংগামা বাধানো। দশ মিনিট পার না হতেই ঝাপিয়ে পরল আমাদের উপর। জানালার কাচ, টেবিলের প্লেট, গ্লাস সবকিছু ভেঙে তুলকালাম ঘটিয়ে ফেল্ল। বার হতে ছিনিয়ে নিল মদের বোতল। স্তব্দ হয়ে গেলাম আমরা, এমন পরিস্থিতি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে আমরাও প্রতিআক্রমনের সিদ্বান্ত নিলাম। রান্নাঘর হতে শেফ ভাই দ্রুত সাপ্লাই দিল চরম ঝাঝালো মরিচের গুড়া। র্মুহু র্মুহু মরিচ আক্রমনে বিষাক্ত হয়ে উঠল রেষ্টুরেন্টের বাতাস, লালে লাল হয়ে গেল আক্রমনকারীদের চোখ মূখ। রনে ভংগ দিয়ে ওরা পিছু হঠল। শেষ রাতে রেষ্টুরেন্ট ভরে গেল সাংবাদিক এবং টিভি ক্যামেরায়। ততক্ষনে পাশের শহর পেইংটন হতে মালিক এসে দায়িত্ব নিল অবস্থার। আমরা ৩ জন আহত, ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং ভীত। মালিক এসে জানাল লুকাতে হবে আমাদের, আমাদের কাজ করার অনুমতি নেই তাই সাংবাদিকদের সামনে হাজির হওয়া যাবেনা। পরদিন স্থানীয় পত্রিকা এবং টিভির হেডলাইন হয়ে এল আমাদের খবর। আমরা ৩জন ততক্ষনে সাধারণ ট্যুরিষ্ট হয়ে মিশে গেছি জনতার মিছিলে। ১৫দিন ছুটি বাকি ফেলে কাজ ছেড়ে পাড়ি দিলাম লন্ডন।