স্মৃতির মনিকোঠায় ১৯৭৫

Submitted by WatchDog on Wednesday, January 27, 2010

1975

১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাস। ভাষা কোর্স সমাপ্ত করে ইউক্রেনের আজব সাগরের তীরে ছোট্ট একটা রিসোর্টে ছুটি কাটাচ্ছি আমরা। তিনদিকে গহীন জংগল, সামনে আজব সাগরের নীলাভ ঢেউ, আর চারদিকে স্বল্প বসনা তরুনীদের উদ্দাম চলাফেরা। সব মিলে স্বপ্ন রাজ্যের নৈসর্গিক পরিবেশ। সদ্য মায়ের কোল খালি করে আসা ক’জন বাংলাদেশী আমরা, চেহারায় কৈশোর আর তারুন্যের সন্ধিক্ষনের ছোয়া। দিনের প্রায় সবটাই কাটিয়ে দেই সাগরের নোনা জলে, বিকেল হলেই হাতছানি দেয় নৈশ জীবনের রংগীন উদ্দামতা। দারুচিনি দ্বীপের মত এমন একটা বিচ্ছিন্ন লোকালয় হতে জননী জন্মভূমি কত হাজার মাইল দূরে ছিল তা হিসাব করার মত সময় আর ধৈর্য্য কোনটাই ছিলনা আমাদের। আমরা এসেছি গেল বছরের ক্লান্তি ধূয়ে আরও একটা বছরের জন্যে তৈরী হতে।

দেশী বিদেশী মিলিয়ে আরও বেশ কিছু ছাত্র আমাদের মতই ছুটি কাটাচ্ছিলো রিসোর্ট এলাকায়। বিভিন্ন ইভেন্টে আর্ন্তদেশীয় প্রতিযোগীতাও ছিল আমাদের ছুটির রুটিনে। এমনই এক ইভেন্টে দৌঁড়াতে গিয়ে পায়ের গোড়ালি মচকে ফেলে আমাদের এক বন্ধু। এম্বুলেন্স এসে তাঁকে নিয়ে যেতে বাধ্য হয় দূরের কোন এক হাসপাতালে। কে যেন আসার সময় একটা রেডিও সাথে এনেছিল, ওটাই আহত বন্ধুকে দিয়ে দেয়া হল হাসপাতালের একাকিত্ব কাটানোর জন্যে। সবার মন খারাপ করে দিয়ে চলে গেল হাসপাতালে। মুঠো ফোন দূরে থাক সাধারণ ফোনেরও ব্যবস্থা ছিলনা ত্রিসীমানায়, তাই যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা রইলনা বাইরের দুনিয়ার সাথে। অদ্ভূদ একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল মধ্যরাতে। আমাদের বাড়িটা দেবে গেছে মাটির সাথে, মা-বাবা, ভাই-বোন সহ কেউ বেঁচে নেই, চারদিকে রক্ত আর রক্ত। ভয়ে আতংকে রুমের বাকি ৩ জনকে ঘুম হতে জাগাতে বাধ্য হই। রাতের বাকি সময়টা না ঘুমিয়ে সবাই মিলে সমুদ্র পারে চলে যাই সূর্য্যোদয় দেখব বলে।

সকাল হতেই আগের দিনের এম্বুলেন্সটাকে দেখা গেল আশপাশে। খবর নিয়ে জানা গেল পাশের ক্যাম্পে কেউ একজন অতিরিক্ত মদ্যপানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। একই হাসপাতালে যাচ্ছে এম্বুলেন্সটা, এবং প্রায় খালি। অনুরোধ করতেই আমাদের ক’জনকে নিয়ে যেতে রাজী হল। বন-জঙ্গল আর আঁকা বাঁকা পথ পেরিয়ে হাসপাতালে পৌঁছতে প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে গেল। গোড়ালিতে ব্যন্ডেজ সহ বন্ধুকে আবিস্কার করলাম হাসপাতাল বেডে, চোখে মুখে ভয়াবহ আতংক। কোন কিছু জিজ্ঞাস করার আগে চীৎকার করে উঠল, ‘মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে আমাদের দেশে!‘। ধীরে ধীরে বলে গেল রাতে শোনা বিবিসির খবর। শেখ মুজিবকে মেরে ফেলা হয়েছে, তার পরিবারেরও কাউকে রেহাই দেয়া হয়নি। দেশে সামরিক শাষন জারী হয়েছে এবং দফায় দফায় চলছে ক্ষমতার পালা বদল। নিথর নিস্তব্দ হয়ে গেলাম আমরা।

১৭-১৮ বছরের তরুন আমরা, বিদেশে এসেছি সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা দেশের প্রতিনিধি হয়ে। গত একটা বছর স্বপ্নের সময় কাটিয়ে দেশকে তুলে ধরেছি বিভিন্ন স্কুলে, কলেজে, হাসপাতালে। যেখানেই গেছি হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে মুক্তিকামী মানুষের বিজয়কে। হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটের উপর, যুদ্বের উপর (আমাদের একজন ছিল যুদ্ব ফেরত), বাংলাদেশ শব্দটা সহ আজম খানের ‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে‘ গানটা গেয়েছি দিনের পর দিন। কিন্তূ সব চাইতে যে প্রশ্নের উপর আমরা বেশী সময় ব্যায় করেছি তা ছিল শেখ মুজিব ও তার জীবনের উপর। স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা আমাদের সাথে ছবি তুলে নিজদের ধন্য করেছে যুদ্বজয়ী একটা জাতিকে সন্মান জানাতে পেরেছে বলে। আমরাও বুকের পাটা ১০ ইঞ্চি সামনে নিয়ে উঁচু মাথায় জয় করেছি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্বের অন্যতম সহযোগী সোভিয়েত দেশের মানুষদের হূদয়। হঠাৎ করেই মনে হল আমাদের পৃথিবীটা মাটিতে নেমে গেছে, মনে হল আজব সাগরের ভয়াবহ জলোচ্ছাস আমাদের ঠেলে দিয়েছে নিঝুম কোন দ্বীপে। কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলামনা। একজন প্রস্তাব করল মস্কো হাইকমিশনে যোগাযোগ করতে। ঘন্টার পর ঘন্টা চেষ্টার পর পাওয়া গেল হাইকমিশনকে। তারাও কোন ধারণা দিতে পারলনা কি হচ্ছে দেশে।

ছুটি শেষ না করেই ফিরে গেলাম শহরে। সরকারী স্কলারশীপের কি হবে এ নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পরলাম আমরা। সাড়াটা দিন কাটিয়ে দেই রেডিওর চার পাশে, কিন্তূ সব খবরেই কেমন অনিশ্চয়তা আর জটিল সমীকরন মেলানোর প্রয়াস। বেশ কিছুদিন লেগে গেল আসল অবস্থা নিশ্চিত করতে। ক্ষমতার জন্যে রক্ত মাংসের মানুষ এতটা পশু হতে পারে আমাদের তরুন মন এর কোন উত্তর খুঁজে পেলনা। শেখ মুজিবকে মেরে ফেলা হয়েছে, আমরা প্রতিদিন খবরের অপেক্ষায় থাকতাম প্রতিবাদের, প্রচন্ড আন্দোলনের, এমনকি সসস্ত্র প্রতিরোধের। কিন্তূ কোথাও কিছু হলনা। আন্ধা আর বোবার মত শুধু শুনে গেলাম একদল খুন করছে, আরেক দল তৈরী হচ্ছে খুনের জন্যে। শিক্ষামন্ত্রী মনসুর আলী আমাদের বিদায় জানিয়েছিলেন এয়ারপোর্টে, উপদেশ দিয়েছিলেন বিদেশে জন্মভূমির সন্মান সমুন্নত রাখতে, শুনিয়েছিলেন ভবিষৎ নিয়ে অনেক আশার কথা। সেই লোকটাকেও মেরে ফেলা হল জেলখানার অন্ধ প্রকোষ্ঠে।

বাংলাদেশ নিয়ে হঠাৎ করেই বদলে গেল সোভিয়েতদের আগ্রহ। রাস্তায় কারও সাথে পরিচয় হলে দুয়ো দিতে শুরু করল শেখ মুজিব হত্যার জন্যে। আমাদের বঞ্চিত করা হলনা স্কলারশীপ হতে, কিন্তূ ঠাঁই দেয়া হল বিশ্বাষঘাতকদের তালিকায়। সেই ’৭৫ হতে অপেক্ষায় ছিলাম প্রতিরোধের, প্রতিবাদের ও বিচারের। শেষ পর্য্যন্ত এল সে দিন, কিন্তূ ততদিনে কৈশোর পেরিয়ে, যৌবন হাতড়িয়ে জীবনের হিসাব নিকাষ চূড়ান্ত করার দাড়প্রান্তে দাড়িয়ে আমরা। আজব সাগরের সেই সমুদ্র রিসোর্ট আজও নিশ্চয় উচ্ছল হয়ে উঠে তারুন্যের পদভারে, সমুদ্রের নীলাভ ঢেউ ’৭৫এর মতই হয়ত আছরে পরে বিস্তৃত কুল জুড়ে। কোথাকার কোন বাংলাদেশের ক’জন কিশোরের সেদিনের চাওয়া, পাওয়া আর কষ্টগুলো কি খুঁজে পাওয়া যাবে সাগরের নোনা জলে? হয়ত না।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন