কাজ শেষে বাসায় ফিরতে মাঝে মধ্যে রাত হয়ে যায়। ই-ট্রেন ধরে জেক্সন হাইট্সে নেমে ৭ নং ট্রেন ধরে যেতে হয় ৬১ ষ্ট্রীট ষ্টেশনে। মানুষের প্লাবনে সদা ভাসমান নিউ ইয়র্ক শহর কখনো ঘুমায় না। তা যত রাতই হোক। সময়টা ৯/১১’র পরের সময়। মার্কিনীরা হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। মিড টাউনের বাতাসে তখনো পোড়া লাশের গন্ধ। পাশাপাশি চলছে ক্ষত শুকিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা। মিডিয়া, কম্যুনিটি, রাজনীতি সব জায়গায় কথা হচ্ছে রিকনসিলিয়েশন নিয়ে। দেশটার সার্বিক উন্নতির অন্যতম সহায়ক শক্তি তার ইমিগ্রেশন, কথাটা প্রায়শই উচ্চারিত হচ্ছে বিভিন্ন ফোরামে। মুসলমানদের প্রোফাইলিং হতে রক্ষা করার জন্যই এসব আয়োজন। যদিও উডসাইড মসজিদের ইমাম জুমার নামাজ শেষে তখনো ইসলামের ’দুশমন’দের ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার দুয়ারে ফরিয়াদ জানিয়ে যাচ্ছেন। তেমনি সময়ের একটা রাত। ট্রেনে করে বাসায় ফিরছ। পরিশ্রমের ক্লান্তি গোটা শরীরে। তাই সহযাত্রীদের দিকে ভাল করে তাকানোর তাগাদা অনুভব করলাম না। আধো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে অপেক্ষা করছি পরবর্তী ষ্টেশনের। টাইম-স্কয়ারে থামতেই ঘুমের ভাবটা কেটে গেল বিশ্রী একটা গন্ধে। যাত্রীদের কেউ একজন সামনের সীটে বসেছে। তার গা হতেই আসছে গন্ধটা। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম তাকরা টাইপের একজন ভারতীয়। পরনে সাদা শার্ট। চেহারাটা ভাল করে দেখার আগে চোখে পড়লো নাকের লম্বা লম্বা লোম। কোনদিন কেটেছে বলে মনে হলোনা। সাদা শার্টের যত্রতত্র মসলার দাগ। ট্রেনে খালি সীটের অভাব নেই, চাইলে বসা যায়। দেখতে খারাপ দেখাবে, তাই উঠা হলোনা। ব্যাগ হতে ম্যাগাজিনটা বের করে পড়ায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলাম। ভয়াবহ ক্ষুধার্ত এবং সহযাত্রীর গা হতে ধেয়ে আসছে গন্ধের বিষাক্ত তীর। ভয় পেয়ে গেলাম চলন্ত ট্রেনেই না বমি চলে আসে। বিরক্তির ভাবটা লুকানোর চেষ্টা করলাম না। পাশের সাদা চামড়ার এক যাত্রী উঠে চলে গেল ট্রেনটার শেষ মাথায়।
টাইম-স্কয়ার ছেড়ে গেল ট্রেনটা। কিছুদূর যেতেই নড়েচড়ে বসলো ভারতীয় যাত্রী। সহসাই মুখ খুলল। মুখে এলকোহলের উৎকট গন্ধ।
- আর ইউ এ ফাকিং মুসলমান?
- নীরবতা
- হোয়াট দ্যা ফাক ইউ ডুইং ইন দিস কান্ট্রি? গো ব্যাক & ফাক দেয়ার হয়্যার ইউ বিলং
- নীরবতা
উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করলো সে। গলার স্বর পৌঁছে গেল হাইয়েষ্ট ডেসিবলে। যাত্রীদের চোখে মুখে ফুটে উঠলো ভীতির ছায়া। মুসলমানদের মা, বাবা, চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে একধারে আউরে গেল সৌরজগতের নিকৃষ্টতম পাঁচালি। ইগনোর করার চেষ্টা করে পড়ার দিকে মন দিলাম। মোটেও থামল না সে। এবার সীট ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। তেড়ে এলো আমার দিকে। হুমকি দিল মাটির পৃথিবী হতে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়ার। বাকি যাত্রীদের সহমর্মিতা চাইল মুসলমান নিধনে। ভারতীয়দের ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না। ওদের আমি ভাল করেই চিনি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস করেছি প্রতিবেশী হয়ে। নিধন করার দৌড় কতদূর তা ভাল করে জানা ছিল। তাই শক্ত হয়ে বসে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম সামনে বসা মানুষ নামের একজন নোংরা কুকুরকে। চোখ বন্ধ করে ক্ষণিকের জন্য ফিরে গেলাম হাওড়া ষ্টেশনে। সেলুলয়েডের ফিতায় দাঁড় করালাম কোলকাতা হতে সুরাত যাওয়ার লম্বা ট্রেন জার্নি। জানালার পাশে বসে আছি। সকালের সূর্য উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছে। ধাবমান ট্রেনের দুপাশে লম্বা লম্বা আগাছা। এবং অনেকক্ষণ ধরে একটা অদ্ভুত জিনিষ লক্ষ্য করলাম, দুলছে আগাছার সাড়ি। সীট ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরলাম উত্তেজনায়। একি দেখছি আমি! গাছের ফাঁকে ফাঁকে বসে আছে অগুনিত মানুষ। মাথা নিচু। ওরা সবাই প্রকৃতির কাজ সমাধা করছে। এ যেন অন্তহীন দৃশ্য। চলছে তো চলছেই। একজন উঠে যাচ্ছে, অন্যজন এসে জায়গা করে নিচ্ছে। এ যেন ফেলারমোনিতে শোনা চায়োকভস্কির সিম্ফোনী!!!
জ্যাক্সনহাইট্সে পৌছার ঘোষণা দিল ট্রেন ড্রাইভার। আমি জানতাম সামনের নোংরা শুয়োরও এখানে নামবে। দরজা খোলার সাথে সাথে ওরা এসে ঘিরে ধরল নাকে লম্বা লোম, শার্টে মসলার দাগ আর গায়ে উৎকট গন্ধের ভারতীয়কে। NYPD, নিউ ইয়র্ক পুলিশ। কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুহাত পিছনে নিয়ে ঘ্যাঁচ করে আটকে দিল। বেরিয়ে যাব এমন যাত্রীদের একজন আমার সামনে দাঁড়ালো। ৭০-৭৫ বছরের এক বৃদ্ধা। ক্ষমা চাইল এবং জানালো এর চাইতে বেশিকিছু করার ছিলনা তার। ৯১১ কল করে পুলিশকে বিস্তারিত জানিয়েছে। পীঠ থাবড়ে দিয়ে বলল, সময়টা এখন খারাপ, ভয় পেলে চলবেনা।
হতে পারে ওরা বিশাল অর্থনীতির দেশের বিশাল বিশাল বিশেষজ্ঞ। কিন্তু প্রত্যেকের ভেতর বাস করে একটা ছোটলোক। অন্যকে হেয় করার এক ধরণের পশুত্ব। অন্তত আমাদের দেখা ভারতীয়দের প্রায় সবাই এই কাতারের। হতে পারে আমার দুর্ভাগ্য।