সময়টা খুব ভাল যাচ্ছিলোনা। চারদিকে অস্থিরতা। এক ধরণের অনিশ্চয়তায় ভুগছে গোটা দেশ। কি হবে, কি হতে যাচ্ছে প্রশ্নটা সবার মুখে। বিশেষ করে নামের আগে পিছে যাদের আবদুল আর মোহম্মদের গন্ধ আছে তাদের বেলায় ব্যাপারটা ছিল আরও জটিল। অথচ অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে ফিরে এসেছিলাম অস্ট্রেলিয়া হতে। মাইগ্রেট করে প্রথমবার যখন দেশটায় আসি তিন মাসের বেশী থাকতে পারিনি। চাকরির সন্ধান করেও ফল পাচ্ছিলাম না। পকেটের অবস্থাও ছিল সংকটজনক। ডালাসের কোন এক নির্জন শহরতলীতে তিন মাস বাস করার পর ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যায়। কোন এক সুন্দর সকালে বাসার সবাইকে অবাক করে দিয়ে লাগেজ হাতে নিতে রওয়ানা দেই ডিএফডাব্লু এয়ারপোর্টের দিকে। সিডনীর এনযাক প্যারেডের উপর মারুবরার বাসাটায় ফিরে হাফ ছেড়ে বাঁচি। কিন্তু এ যাত্রায় এখানেও সুবিধা করতে পারলাম না। তিন মাসের মাথায় পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়া হতে বন্ধু আরশাদের ফোন পাই। দ্রুত ফিরে যেতে অনুরোধহ করলো এবং এ যাত্রায় ওয়েস্টের দিকে না গিয়ে যেন ইস্টকোষ্টে যাই তার আমন্ত্রণ জানালো। সাতপাঁচ না ভেবে ফিরে আসি মার্কিন মুলুকে। অর্থনীতি ও চাকরীর বাজারে ততদিনে ধ্বস নামতে শুরু করেছে দেশটায়। রিপাবলিকান যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ক্ষমতারোহনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছি এক ধরনের এন্টি-ইমিগ্রান্ট আবহ। বন্ধু আশ্বস্ত করল একটা কিছু বের করা যাবে যেভাবেই হোক। তিন মাস বলতে গেলে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম বন্ধুর অতিথি হয়ে। ২০০১ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর। সকাল সকাল গোসল সেরে তৈরি হচ্ছি নিউ ইয়র্ক যাত্রার জন্য। ১০ং স্ট্রীট হতে এমট্রেক ট্রেন ধরতে হবে। কাপড় ইস্ত্রি করছি এবং পুরানো অভ্যাস মত সিএনএন’এর দিকে চোখ রাখছি। অদ্ভুত একটা আগুনের লেলিহান শিখাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে খবর। টুইন টাওয়ারের একটায় আগুন লেগেছে। ভাবলাম তেমন কিছু না। উন্নত দেশ নিশ্চয় কিছুক্ষণের মধ্যে আয়ত্তে নিয়ে আসবে আগুন। কিন্তু পরমুহুর্তে যা দেখলাম তাতে শক্ত হয়ে গেল শিরদাঁড়া । যাত্রীবাহী বিমান আছড়ে পরছে টুইন টাওয়ারের দ্বিতীয় বিল্ডিঙটায়। কেবল তখনই মনে হলে বড় কিছু একটা ঘটছে এ দেশে। থেমে গেল আমার প্রস্তুতি। নিউ ইয়র্ক হতে বন্ধু রাহমানের ফোন পেলাম। অবস্থা ভয়াবহ সেখানে। সন্ত্রাসীদের আক্রমণে তচনচ হয়ে গেছে শহরের জীবন।
দুটা দিন অপেক্ষা করে ১২ই সেপ্টেম্বর আবারও পা বাড়াই অনিশ্চিত পথে। এ যাত্রায় বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী নিউ ইয়র্ক। বন্ধু আগ বাড়িয়ে ঠিক করেছিল আমার ঠিকানা। মাসিক ৬০০ ডলারে উডসাইডের বেইসমেন্টের একটা রুম। মালিক নিজেও একজন বাংলাদেশি। পকেটের কারণে চাকরির বাজারে ঘোরাফেরার মাত্রাটা বাড়াতে হল। ম্যানহাটন তখনও অবরুদ্ধ। এনজিনিয়ারিং বাজার মনে হল তালাবন্ধ। বাধ্য হয়ে অন্য রাস্তা ধরতে হল। শেষ পর্যন্ত কুইনস বুলোবার্ডের উপর একটা চেইন ষ্টোরে কমিশন ভিত্তিতে মালামাল বিক্রির চাকরি পেলাম। খুবই চ্যালেঞ্জিং যব। আমি ছাড়াও ডিপার্টমেন্টে আরও ১৫ জন কাজ করছে। তাদের টেক্কা দিয়ে আমাকে রোজগার করতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। তাই প্রস্তুতি নিলাম চ্যালেঞ্জের। কোন এক সোমাবার সকালে কাজে হাজির। পরনে কালো প্যান্ট আর গায়ে সাদা শার্টের সাথে কালো টাই। কেতাদুরস্ত সেলসম্যানের মত নিজকে উপস্থাপন করলাম ম্যানাজারের কাছে। সুন্দরী মহিলা আগ্রহ ভরে দেখলো আমাকে এবং মুচকি হাসি দিয়ে স্বাগত জানালো যুদ্ধের মাঠে। কোথা হতে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। প্রথম সপ্তাহটা নির্ধারিত ছিল ট্রেনিংয়ের জন্য। কাউন্টারের পেছনে অলস দৃষ্টিতে চারদিকের ব্যস্ততা দেখতে শুরু করলাম। এমন সময় দেখতে ঠিক আমাদের মত একজন মহিলা এসে কর্কশ ভাষায় জানতে চাইলো কাউন্টারের পেছনে আমি কি করছি। মুখে চিরাচরিত ভারতীয় ইংরেজি। এখুনি সরে না গেলে সিকিউরিটি ডাকতে বাধ্য হবে বলে হুশিয়ারি দিল। ঠাণ্ডা একটা অজগর সাপ কিলবিল করে নেমে গেলো আমার শরীর বেয়ে। বেয়ারা মুখটা খোলার আগেই ম্যানেজার মহিলা এসে সামনে দাঁড়ালো। পরিচয় করিয়ে দিল নতুন এম্পলয়ি হিসাবে। ভারতীয় মহিলার মুখ বর্জ্য নির্গমের পর গরুর পশ্চাৎ-দেশ যেমন দেখায় ঠিক তেমনি দেখালো। চোস্ত মার্কিন ইংরেজিতে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা দিলাম। এবং পাশাপাশি আমার ব্যাকগ্রাউন্ড অস্ট্রেলিয়ান-বাংলাদেশি বুঝিয়ে দিতে ভুল করলাম না। চরম বিরক্তি নিয়ে নিজকে পরিচিত করলো। সুনীতা। বাড়ি ভারতের পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কোলকাতায়। বাংলাদেশি পরিচয় পেয়ে হিন্দি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার উপর। প্রথম বাক্য উচ্চারণের পর ঠাণ্ডা গলায় থামিয়ে দিলাম। বুঝিয়ে দিলাম হিন্দি বুঝিনা। আমি ইংরেজিতেই স্বছ্যন্দ বোধকরি। বাংলা প্রথম ভাষা হলেও আমার দ্বিতীয় ভাষা রুশ এবং তৃতীয় ইংরেজি। বিয়ের প্রথম রাতে বিড়াল মারতে পেরেছি কিনা বুঝতে পারলাম না। কিছুটা সময় নিয়ে সুনীতা মুখোপাধ্যায় খুব শুকনো গলায় অভিযোগ করলো চাকরিই যদি করতে এসেছি তাহলে কাউন্টারের পিছেন কি করছি! আমি কিছু বলার আগে ম্যানেজার মুখ খুললো, ‘ও এক সপ্তাহ ধরে ট্রেনিংয়ে থাকবে এবং নিজের জন্য কোন কাষ্টমার ধরতে পারবেনা।’ কঠিন একটা চাউনি দিয়ে মুখোপাধ্যায়-জী চলে গেলে নতুন কোন গ্রাহকের সন্ধানে। ম্যানেজার সহানুভূতি প্রকাশ করে জানালো সুনীতা এখানে সবার সিনিয়র এবং তার স্বভাবটাই এরকম। জবাবে খুব শুকনা গলায় বলেছিলাম, ফ্লোরেই দেখা হবে!
দেখা হয়েছিল ফ্লোরেই। এবং একে একে চার বছর। সে আরেক অধ্যায়। তা নিয়ে সময় করে লিখা যাবে। তবে আগ বাড়িয়ে এটুকু বলতে পারি তাকে দুমড়ে, মুচরে, আছড়ে শিক্ষা দিয়েছিলাম প্রথম দিনের বেয়াদবির। বড় দেশ হলেই যে বড় হওয়া যায়না তা তাকে আয়না দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি। চার বছর অন্তত চার বার আমাকে মুখোমুখি করিয়েছে স্টোর ম্যানেজমেন্টের। উদ্দেশ্য, চাকরিচ্যুতি। কাজ হয়নি। বরং ফ্লোরেই জবাব দিয়েছি সব হিংসার। মহিলা ছিল সর্বোচ্চ আয়ের সেলসপারসন। বছর না ঘুরতে ঠাঁই হল দুই নাম্বারে। তাও আমার আয়ের আর্ধেক। তিন বছরের মাথায় তাকে নামিয়ে আনি ছয় নাম্বারে। চার বছরের মাথায় নেয় অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। তার বিদায় আসরে আমি ঘোষণা করি আমার সিদ্ধান্ত...টেলিকম এঞ্জিনীয়ারের চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছি আমেরিকার ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্টে। খুনির চাউনি দিয়ে তাকালো আমার দিকে। আমিও হাসলাম আমার শেষ হাসি।