সমাজ, সংসার তথা আন্ত-পারিবারিক ঘাত প্রতিঘাত তখনও ক্ষত-বিক্ষত করেনি আমাদের পরিবারকে। নয় ভাইবোন সাথে ফুফাতো ভাইবোনদের কেউ কেউ, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ নিয়েই আমরা বেড়ে উঠেছি। সকাল হতেই চালু হয়ে যেত রান্নার মেশিন। ওখানে মার নেতৃত্বে দুই-তিন জোড়া অতিরিক্ত হাত সার্বক্ষনিকভাবে নিয়োজিত থাকতো আমাদের চাহিদা মেটাতে। সকালের মেনু গরম ভাত, সাথে আলুর ভর্তা ও শুকনা ডাল। করলা ভাজির সাথে তাজা ঘি, স্মৃতির মেঠোপথে এসব ছিল অমৃত। বিশেষ করে শীতের সকালে বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে নাস্তার পর্বটা ছিল অদ্ভুত ভাল লাগার। বারান্দার পাশেই ছিল ডালিম ও কামরাঙ্গা গাছ। আমার অভ্যাসই ছিল খেতে বসে ভাত ছিটিয়ে গাছের ডাল হতে পাখিদের নামিয়ে আনা। যদিও পাখি বলতে ছিল কেবল নিকস কালো কিছু কাক ও সদা ব্যস্ত কতগুলো চড়ই। ডালে ভাতে কখন আমরা বড় হতে শুরু করেছি টেরই পাইনি। আব্বা রাজনীতি ও ব্যবসা নিয়ে সদা ব্যস্ত। মাকেই শক্ত হাতে হাল ধরতে হয়েছিল বিশাল এ পরিবারের। বেড়ালের প্রতি মার দুর্বলতা ছিল মৃত্যু পর্যন্ত। সূর্য ডোবার পর মা খুব হাল্কা পায়ে আমাদের লেখাপড়া পরখ করতে আসতেন। কিন্তু একটা জিনিস মা জানতেন না উনার পোষা বেড়ালদের কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে আমাদের জানান দিত মার আগমন। আমরাও তৈরি থাকতাম এবং উচ্চস্বরে কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার গল্প পড়তে থাকতাম। মা খুশি হয়ে ফিরে যেতেন।
বছরের বার মাসের মধ্যে সবচেয়ে ঘটনাবহুল মাস ছিল রোজার মাস। এ মাসের প্রস্তুতি শুরু হত বেশ আগ হতেই। একজন হুজুর আসতেন এক মাসের জন্য। মূল কাজ ছিল ইফতারির পর মগরেব ও তারাবী নামাজে ইমামতি করা। রান্নাঘরের স্টক থাকতো টইটম্বুর। ইফতারির আয়োজনে থাকতো কম করে হলেও দশ পদ। শুরু বেলের শরবৎ দিয়ে। বাংলা-ঘরের এক রুম খালি করা হতো এক মাসের জন্য। ওখানে চাদর বিছিয়ে আমরা সবাই অপেক্ষা করতাম আজানের। রেডিওটা সামনে থাকতো। ইফতারের আওয়াজ দেয়ার সাথে সাথে হুজুর চলে যেতেন আজান দিতে। আমাদের কেউ অন্দরমহলে গিয়ে পৌঁছে দিতাম ইফতারের বার্তা। দিনের শেষটায় বাকি থাকতো রাতের খাবার। এই একটা মাসই বোধহয় আব্বাকে কাছে পেতাম রাতের খাবারে। কত পদ রান্না হতো তা বোধহয় হিসাবে করে শেষ করা যেতো না। ভর্তাই থাকতো চারপাচ পদের। খাবার শেষে আমার জন্য ঘনিয়ে আসতো দুঃসময়, তারাবি! উপায় নেই, আব্বার কড়া নজরদারী হতে পালানোর কোন পথ ছিলনা। দলবেঁধে যোগ দিতাম তারাবী নামাজে। সাথে থাকতেন প্রতিবেশী অনেকে। নামাজ শেষে থাকতো স্পেশাল চা ও বিস্কুটের আয়োজন। ধর্মীয় অনুষ্ঠান এক সময় রূপ নিত সামাজিক অনুষ্ঠানে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামত। নতুন দিনের প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে যেতাম বিছানায়। শেষরাতে সেহেরি খেতে চাইলে কাউকে পাঠিয়ে মা ঘুম ভাঙ্গাতেন। ঘরে তৈরি দই খাওয়ার লোভে মাঝে মধ্যে উঠতাম। যে বছর বুবু বাড়ি থাকতেন শেষ রাতে শোনা যেত ওনার পান ছেঁচার টুং টাং আওয়াজ। শেষরাতে দূরের রেলগাড়িটার দাপাদাপি মনে হতো ঘরের আঙ্গিনায়। দরজা খুলে বাইরে এলে দিগন্ত জুড়ে ভেসে উঠত খোলা আকাশ। চাইলে মেঘনার পাড় ঘেঁষে থেমে থাকা নৌকাগুলোর নিভু নিভু বাতিগুলোও দেখা যেত খালি চোখে।
চলবে