আলীবাবা চল্লিশ চোরের গল্পের সাথে আমাদের সবার কমবেশি কিছু পরিচয় আছে। এক হাজার এক রাত্রির আরব্য উপন্যাসে এই গল্পের সংযোজন ছিল অভূতপূর্ব। পৃথিবীর দেশে দেশে এ গল্পের পরিচিতি আছে। আছে উপসংহার টানার সংস্কৃতি। বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতির গোটা প্রেক্ষাপটটাই দাঁড়িয়ে এই গল্পের ভিত্তির উপর। রাজনীতির মাঠ গরম করা প্রত্যেকটা চরিত্রকে আলীবাবা গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের সাথে সহজেই মিলিয়ে দেয়া সম্ভব। বাড়িঘর, ঘটিবাটি বিক্রি করে ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজেদের নাম লেখানোর যে অসৎ ও বিভীৎষ প্রতিযোগিতা তার নামই নির্বাচন। এ মুহূর্তে নির্বাচন মানে গল্পের সেই 'সিসিম ফাঁক' মন্ত্র হাতে পাওয়া। আর তা হাতে পেলে দেশ নামক গুহাটার খাজাঞ্চিখানা সহজেই খোলা সম্ভব। আর তা করা গেলে কেবল নিজের নয়, সামনের সাত প্রজন্মের দুধে ভাতে বেচে থাকার নিশ্চয়তাও দিয়ে যাওয়ায় সম্ভব। আজকের জাতীয় রাজনীতি হতে শুরু করে সদ্য সমাপ্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচন তারই প্রতিচ্ছবি। সিসিম ফাঁক মন্ত্রটা সবারই চাই। তাই আমাদের সমাজে রাজনীতি আজকে এমন একটা গরম জিনিস যা নিয়ে ঘরে ঘরে লড়াই চলে। ভাই যায় ভাইয়ের বিরুদ্ধে, সন্তান যায় তার জন্মদাতা পিতার বিরুদ্ধে, গৃহবধূ স্ত্রী আচল বেধে নামে স্বামীর বিরুদ্ধে। শৈশব ও কৈশোরে দেখা আমাদের পরিবারটা ছিল ঠিক উলটো। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত রাজনীতি করার অশ্রুত উদাহরণ চাইলে সেখানে সহজেই দাড় করানো যাবে আমাদের পরিবারকে। নিজের ভাগ্যলক্ষ্মীকে আব্বা কিভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন তার একটা ইতিহাস আছে। সে ইতিহাসে অবৈধ পথের কোন স্থান ছিলনা। পথের সবটা জুড়ে ছিল শ্রম, মেধা আর আত্মবিশ্বাসের ধারাবাহিকতা। সাফল্যের শীর্ষে বসেই আব্বা রাজনীতি শুরু করেছিলেন। অশ্রুত জনপদ হতে শূন্য হাতে উঠে এসে পৌঁছেছিলেন সাফল্যের চূড়ান্ত শীর্ষে। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, বিভিন্ন পার্লামেন্ট কমিটির সক্রিয় সদস্য হয়ে পেয়েছিলেন জাতীয় পরিচিতি। সমাজ সেবার অপর নামই যদি রাজনীতি হয়ে থাকে তাহলে আব্বার রাজনৈতিক ও সামাজিক অধ্যায় যুগ যুগ ধরে উদাহরণ হয়েই থেকে যাবে। ক্ষমতার শীর্ষে বসে নিজের মহত্ব প্রমাণ করতে নিজে সিসিম ফাঁক মন্ত্রের আশ্রয় নেননি, বরং এতদিনের পরিশ্রমে গড়ে তোলা বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যকেই বলি করেছিলেন।
মানুষ মাত্রই ভুল করতে বাধ্য। নবী পয়গম্বরদের হয়ত ভুল ছিলনা। বাকি সবার বেলায় এই ভুল এক কথায় বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে চলে যায়। আমরা জেনে হোক আর জেনে হোক ভুল করি। আমার বিচারে ভুল হতে শিক্ষা নেয়ার ক্ষমতাটাই একজনকে অন্যজন হতে পার্থক্য করে দেয়। আমাদের বিশাল যৌথ পরিবারে এই শিক্ষা নেয়ার প্রবণতাটাই চর্চিত হয়নি। যার মূল্য পরবর্তীতে আমাদের সবাইকে চরমভাবে শোধ করতে হয়েছে। আমি আমার নিজের ঘরেই যখন আলীবাবা চল্লিশ চোরের সিসিম ফাঁক মন্ত্র বলে ইঁদুর কায়দায় গাঁট কাটতে শুরু করবো সে ঘর খসে পরতে বাধ্য, সে ঘর ধ্বংস হতে বাধ্য। যে বাড়ির শৌর্য বীর্য একসময় উপকথার মত ছিল সে বাড়ি আজ শূন্য, পরিত্যক্ত। বাড়ির প্রতিটি বাঁকে আজ ভূত প্রেত্মাদের অবাধ আনাগোনা। অথচ এ বাড়ির নিজস্ব একটা ছন্দ ছিল, সূর ছিল। সে সূরের মূর্ছনায় আমরা বড় হয়েছি, পৃথিবী আবিষ্কার করতে শিখেছি। জীবন নামক যুদ্ধ জয় করতে আমরা আঁকাবাঁকা অনেক বন্ধুর পথ খুঁজেছি। অথচ কোনদিন ভেবে দেখিনি শক্তির বিশাল এক ভাণ্ডার লুকানো ছিল আমাদের এই বাড়িটাতেই। ছয় ভাই, তিন বোন...চাইলে বিশ্বকে নামিয়ে আনা যেত পায়ের নীচে। ছিল নাম, ছিল ডাক, ছিল প্রতিপত্তি। অথচ আজ নিভু নিভু বাতির মত সব নিভছে। অবিশ্বাস, অনাস্থা, ভুল বুঝাবুঝি এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যেখান হতে সড়ে আসার সব রাস্তা এখন সংকীর্ণ। ছোট বোন গেল, ছোট ভাই আনিসও তার জীবন নিয়ে চরম এক বাস্তবতার মুখোমুখি। অথচ আমরা কেউ পাশে এসে দাড়াতে পারিনি। কাঁধে হাত রেখে বলতে পারিনি এ যুদ্ধ তোদের একার নয়। এ যুদ্ধ আমাদের সবার। একত্রে হারবো... একত্রে জয় করবো।