সময়টা ’৯৫ সাল, অষ্ট্রেলিয়াতে সবেমাত্র মাইগ্রেট করেছি। সিডনির কেনসিংটনে ২ রুমের একটা ফ্লাটে আরও দু বাঙালীর সাথে শেয়ার করছি। ১১ বছরের ইউরোপীয় জীবন শেষে বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছিলাম মা, মাটি আর মানুষের টানে। প্রথম চাকরী, প্রথম প্রেম, প্রথম ভালবাসা, প্রথম বিরহ, এমন অনেক কিছুই ছিল প্রথম, যার মাঝে মিশে গিয়ে কখন যে মাছে-ভাতের বাঙালী বনে গিয়েছিলা বুঝতেও পারিনি। আমি না বুঝলে কি হবে, আমাকে বুঝিয়ে দেয়ার মানুষের কিন্তূ অভাব হলনা। রাজনীতির পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত একটা দেশে সূস্থ হয়ে বেচে থাকতে চাই ঈশ্বরের বিশেষ আশীর্বাদ, সে আশীর্বাদ পাওয়ার যোগ্যতা আমার কোন কালেই ছিলনা, কারণ ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব নিয়েই আমি ছিলাম দ্বিধান্নিত। রোজার ঈদ সামনে, চারদিকে মহা আয়োজন। বরেন্দ্র গভীর নলকুপ বিদ্যুতায়ন প্রকল্প নিয়ে নওগা জেলার হাওর-বাওর চষে বেড়াচ্ছি। ৭/৮ জন সহকারী প্রকৌশলী সহ একটা টিম নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি গাধার মত। ঈদের সময়, সবার বেতন চাই, ভাতা চাই, বোনাস চাই, চারদিকে শুধু চাই আর খাই খাই ভাব। কাজের পারিশ্রমিক আদায়ের লক্ষ্যে রাজশাহী বিদ্যুৎ অফিসে বিল জমা দিতেই আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল অন্য এক জন্মভূমি। চাঁদপুরের অধীর সাহা নির্বাহী প্রকৌশলী, খুলনার আবু বকর সহকারী প্রকৌশলী, রহিম সাহেব প্রধান প্রকৌশলী, ইত্যাদি ইত্যাদি, সবাই আমাকে ডেকে পাঠাল আপন কুঠুরীতে, ব্যক্ত করল নিজ নিজ চাহিদা। শুভ্র দাড়িওয়ালা দুই হাতে ১১ আংগুলের আবু বকরকে সৃষ্টিকর্তা বোধহয় অতিরিক্ত একটা আংগুল দিয়েছিলেন পাপের টাকা গোনার জন্যে। সেই আঙ্গুল দিয়েই গুনলেন টাকাগুলো এবং তা ছিল শেষ তারাবির ওজু অবস্থায়। মসজিদে ওজুরত প্রকৌশলীর ঘুষ গ্রহন, এ দৃশ্যটা আমাকে সাড়া জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে ঈশ্বরের নৈকট্য হতে।
পত্নীতলা, বদলগাছি, মহাদেবপুর এবং ধামুইরহাটের ধানচাষীদের সাথে অন্যরকম একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এক বছরে, তাদের অনেকের আতিথেয়তা আবু বকরদের মত অসৎ মানুষদের কলুষতার নীচে চাপা পড়তে দেয়নি। আমার মুখ হতে শোনা বিদ্যুৎ আগমনী বার্তা তাদের কাছে ছিল রূপকথার কল্প-কাহিনীর মত। পৃথিবীর উত্তর দক্ষিন মেরুর অনেক প্রান্ত চষে বেড়িয়েছি, হরেক রকম মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, কিন্তূ নওগা জেলার সীমান্ত এলাকার ঐ মানুসগুলোর কথা আমার এই কাচা কলম দিয়ে মূল্যায়ন করলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। বরং তাদের কথা, এবং সে এলাকার মানুষ গুলোর বেচে থাকার লড়াইয়ের কথা জন্মভূমির ভাল কোন কিছুর প্রতীক হিসাবে তুলে রাখব হূদয়ের খুব গভীরে। ঈদ শেষে প্রমোশন পেয়ে প্রকল্প প্রকৌশলী হতে প্রকল্প পরিচালক হয়ে মুক্তি পাই অবৈধ লেনদেনের এই অস্বাস্থ্যকর চক্র হতে, কিন্তূ পাশাপাশি মিস করতে শুরু করি খুব কাছ হতে জন্মভূমিকে দেখার র্নিভেজাল সূযোগকে।
বেশীদিন টিকতে পারিনি ঢাকা শহরে, মোহম্মদপুরের ছোট অফিসটায় রাজনীতি নামের গুন্ডাদলের নিয়মিত পদধূলি জীবন অতিষ্ঠ করে তুলে। সকালে চাঁদা, বিকেলে চাদা, রাতে চাঁদা, বিএনপির চাদা, আওয়ামী চাদা, ওয়াজ মাহফিল, ব্যডমিন্টন টুর্নামেন্ট, একুশে ফেব্রুয়ারী, রাস্তায় নিহত পথচারী সৎকারের চাঁদা, চাঁদার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে গিয়ে একটা সময় এল যখন জীবন যুদ্বের এ পর্ব পূনঃমূল্যায়ন করতে বাধ্য হলাম। অনেক আগে বাংলাদেশ বিমানের একটা কমার্শিয়াল দেখতে খুব ভাল লাগত, ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী‘। হঠাৎ করে আমার পৃথিবীও কেমন যেন ছোট মনে হল, শ্বাষ নিতেও কষ্ট হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিতে আমার অফিসে কোন এক সুন্দর সকালে হাজির হয় খোলা তরবারির মত ধারালো অনিত্য সুন্দরী এক টিভি মডেল, তার ফোন করা দরকার। এভাবেই শুরু, তারপর তাকে প্রায়ই দেখা যেত আমাদের অফিসে, না না ছুতায়, হরেক রকম বাহানায়।
দিনটা ভূলে যাওয়ার মত ছিলানা, অঝোর বর্ষনে কাঁদছিল ঢাকা শহর। শ্রাবনের বর্ষনে ভরা এমন একটা দিনের কথা ইউরোপে বাস করতে গিয়ে কত শতবার যে কল্পনা করেছি তার হিসাব নেই। গভীর তন্ময়ে মোহগ্রস্থ হয়ে গিলছিলাম বৃষ্টির বিরামহীন কান্না। দলবেধে তারা এল, বয়স ১৮ হতে ৩০। হাতে হরেক রকম অস্ত্র; ছুরি, রামদা, নানচাকু, পিস্তল। বাসা হতে পালিয়েছে টিভি কন্যা, যাওয়ার সময় বান্ধবীদের বলে গেছে মোহম্মদপুর অফিসের ঐ প্রকৌশলীর সাথে জীবন গড়তে পা বাড়াচ্ছে অচেনা পথে।
চলবে...