হঠাৎ করেই সবকিছু বদলে গেল যেন। পশ্চিম দিগনন্তে রক্তিম সূর্য্যটা মিলিয়ে যেতেই অন্ধকারে ঢেকে গেল যতদূর চোখ যায়। এতক্ষন ধরে রাজত্ব করা দানবীয় ট্রাকগুলোও ভোজবাজির মত হাওয়া হয়ে গেল হাইওয়ে হতে। ডান বায়ে যতদূর চোখ যায় জীবনের কোন ছোয়া নেই, শুধু পথ আর পথ, আকাবাকা এবং উচুনীচু। হাই বীমের হেডলাইট্টা লো বীমে নামিয়ে চারদিকের নীরবতাকে সন্মান জানালাম, বড্ড বেখাপ্পা লাগছিল এমন একটা স্বপ্নীল পরিবেশে এই চড়া আলোর বাড়াবাড়ি। গাড়ির কাচ নামিয়ে দিলাম ভেতরের ভারী পরিবেশটাকে হাল্কা করব বলে। বাধ ভাঙা জোয়ারের মত বাতাসের শো শো শব্দ তচনচ করে দিল এতক্ষনের নীরবতা। প্রেইরী অঞ্চলের এই ভৌতিক নীরবতা সাথে বিনা নোটিশের কন কনে শীত আমেরিকার বন্য পশ্চিমের বৈশিষ্ট্য। ছোট বেলায় পড়া সেবা সিরিজ অনূদিত উপন্যাসগুলোর কথা মনে করে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করলাম। বন্ধ করতে বাধ্য হলাম কাচের জানালাটা। ততক্ষনে মধ্য আকাশে চাঁদের দেখা মিল্ল, আকারে ছোট, কিন্তূ তাতেই ভাসিয়ে নিল প্রেইরীর জনশূন্য মাঠ ঘাট। কাব্যিক জোৎস্নায় দূর হয়ে গেল কিছুক্ষন আগের ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনটা অকারনেই ভাল হয়ে গেল।
ফ্লাগষ্টাফ শহরটায় পৌছতে পৌছতে রাত ৯টা বেজে গেল। অনলাইনে হোটেল বুক করিনি ইচ্ছে করেই। জায়গায় পৌছে যাচাই বাছাই পূর্বক হোটেল পছন্দের ভেতর এক ধরনের ভোতা আনন্দ পাওয়া যায়, এ অনেকগুলো বছর ধরে ভ্রমনের ফসল। অবশ্য অনলাইন হতে প্রাথমিক একটা ধারণা নেয়া ছিল কোথায় খুজতে হবে। প্রথমে ঢু মারলাম বাটলার ষ্ট্রীটের উপর হোটেল 'রডেও ইন্'এ। যেমনটা ধারণা করছিলাম তাই হল, কাউন্টারে দেখা মিল্ল মধ্য বয়স্ক একজন ভারতীয়র। হিংসে হয় এ সব ভারতীয়দের দেখলে। মার্কিন মুলুকে তাবৎ মোটেল ব্যবসার মালিক এরা। টেক্সাস অংগরাজ্যের সান আন্তনিওতে যা দেখেছি এখানেও এর ব্যতিক্রম হল না। গোটা পরিবার মিলে ব্যবসাটা দেখাভাল করে থাকে। চোস্ত ভারতীয় উচ্চারনের ইংরেজীতে জানতে চাইল আমার প্রয়োজন। কাউন্টারে ঝুলছে ফ্রেমে বাধানো লাইসেন্স, ‘শ্রী হনুমান বালাজী এলএলসি‘র ব্যবস্থাপনায় চলছে এ মোটেল। রিশেপসেনিষ্ট নিজকে মাইক প্যাটেল বলে পরিচয় দিল, গুজরাটের সূরাত নগরীর বাসিন্দা। দুঃখের সাথে জানাল নন-স্মোকিং রুম খালি নেই, তাছাড়া রেট যা বলছে তার সাথেও এক হতে পারলাম না। বেরিয়ে পরলাম অন্য আরেকটার সন্ধানে। বেশীদূর যেতে হলনা, রাস্তার ওপারেই পাওয়া গেল ট্রাভেল্লজ নামের মোটেলটা। এবং আবারও সেই ভারতীয়। স্বামী স্ত্রী হাত দিয়ে রুটি সবজ্বি খাচ্ছে বিপদজনক তৃপ্তি নিয়ে, আমাকে দেখতেই একই উচ্চারনে স্বাগত জানাল। রুম পাওয়া গেল একটা, টেক্স সহ ৯৫ ডলার। ৩০-৪০ ডলারের রুম ছিল আমাদের টার্গেট, কিন্তূ স্মিতা সিং’এর সাথে আলাপ করে জানা গেল আজ শনিবার তাই হোটেল ভাড়া নিয়মিতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন। লম্বা জার্নির কারণে ক্লান্তি এসে বার বার জানান দিচ্ছিল, শরীরের সাথে কম্প্রোমাইজ করার ইচ্ছে হল না আর। নিয়ে নিলাম রুমটা।
ফ্লাগষ্টাফ হতে গ্রান্ড ক্যানিয়নের দূরত্ব প্রায় ৯০ মাইল (১৫৪ কিমি), এক ঘন্টার উপর ড্রাইভ। গরম পানিতে অনেকক্ষন ধরে গোসল করে মুছে ফেললাম শরীরের সমস্ত ক্লান্তি। হাল্কা পোশাকে বেড়িয়ে পরলাম রাতের খাবারের সন্ধানে। ’ড্যানি’ নামের চেইন রেষ্টুর্যান্টের সাথে আগে হতেই পরিচিত ছিলাম, তাই ঢুকে পরলাম বিনা দ্বিধায়। ভেতরে খদ্দেরের এতটা ভীড় হবে একেবারেই আশা করিনি। মধ্য সেপ্টেম্বরেও ট্যুরিষ্টদের আনাগোনার কোন কমতি মনে হল না, অন্তত রেষ্টুরেন্টের ভীড় দেখে। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় ব্যয় হল ডিনার শেষ করে রেষ্টুরেন্ট হতে বেরিয়ে আসতে। খুব সকালে বেরিয়ে পরতে হবে, তাই অন্যকোন এডভেঞ্চারে না গিয়ে সড়াসড়ি বিছানায় এলিয়ে পরলাম। পরবর্তী ঠিকানা গ্রান্ড ক্যানিয়ন।
কাল রোবাবার, এবং ঈদ। চাইলেও সহজে ঘুম এল না, সমুদ্র মহাসমুদ্র পেরিয়ে বাংলাদেশের ছোট জেলা শহরে আমাদের সেই বাড়িটার সৃত্মি বার বার সামনে এসে দাড়াল। ছোট বেলায় ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে আমাদের ছাদে হৈ হুল্লোর পরে যেত, কে আগে দেখছে এ নিয়ে সারা রাত তর্ক হত ভাইবোনদের মধ্যে। আর রেডিওতে উচু স্বরে ’রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটা শোনার সাথে দাঁড়িয়ে যেত শরীর সবগুলো লোম, এ গানটার মাঝে খুজে পেতাম ঈদের আগমনী বার্তা, যার জন্যে বছর ধরে অপেক্ষায় থাকতাম। মা-বাবা বেচে থাকলে পারতাম কি এমন একটা নির্বাসীত পরিবেশে ঈদের আগের রাতটা কাটাতে? এক ধরনের বোবা কান্নায় বুকটা ভারী হয়ে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম টের পেলমা না।
-চলবে।