ড্রাগ, সুন্দরী আর সাগর পারের দেশ কলোম্বিয়ায় - ৪র্থ পর্ব

Submitted by WatchDog on Thursday, February 4, 2010

Columbia

এই এক উট্‌কো ঝামেলার কারনে বিদেশ ভ্রমন অনেক সময় চরম বিরক্তির উদ্রেক করে। ব্যাপারটা প্রথমবারের মত কটু হয়ে ধরা পরে ওসাকা হয়ে জাপান ঢুকার পথে। সিডনী হয়ে লস এঞ্জেলস্‌ যাচ্ছি। ওসাকায় ১৮ ঘন্টার ব্রেক। এয়ারপোর্টে এত লম্বা সময় কাটিয়ে প্রায় ১৩ ঘন্টা আকাশ ভ্রমন স্বাস্থ্যের উপর দিয়ে যাবে, তাই সিদ্বান্ত নিলাম শহরেই কাটিয়ে যাব সময়টা। জাপানে এই প্রথম, তাই এক ঢিলে দুই পাখী মারার লোভটাও কাজ করল ভেতরে ভেতরে। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে অষ্ট্রলিয়ান পাসপোর্টটা জমা দিতেই সন্দেহের মধ্যরাত নেমে এল খুদে চোখের জাপানী অফিসারের জন্যে। সম্ভাব্য সব এংগেল হতে পাসপোর্টাকে যাচাই বাছাই করেও কিছু পেলনা, শেষমেশ আশ্রয় নিল প্রযুক্তির। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, লাইনের বাকি অষ্ট্রেলিয়ানরা পার হয়ে গেল ২/১ মিনিট সময় ব্যায় করে। ভেতরে ততক্ষনে অজগর সাপের তর্জন গর্জন শুরু হয়ে গেছে আমার। ধৈর্য্যের শেষ সীমায় গিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভে জানতে চাইলাম সমস্যাটা কোথায়, আমার চামড়ায় না পাসপোর্টে? ছোট চোখ দুটো বেশ কিছুটা বড় করেই তাকাল আমার দিকে, ’দিস ইজ আওয়ার রেগুলার প্রসিডিংস, উই হ্যাভ টু গো থ্রু দিস‘। ’হোয়াট ইউর প্রসিডিংস সে, এম আই ফেইক অর মাই পাসপোর্ট ইজ ফেইক?‘ এমন একটা আক্রমনাত্ত্বক উত্তরে আশপাশের অনেকেই ফিরে তাকাল। বস গোছের কেউ একজন এগিয়ে এল, কিছুক্ষন নিজদের ভেতর গাইগুই করে ৯০ দিনের ভিসা দিয়ে ফিরিয়ে দিল পাসপোর্টটা। কর্কশ একটা ধন্যবাদ দিয়ে জানিয়ে দিলাম ৯০ দিনের ভিসার দরকার ছিলনা আমার, ২৪ ঘন্টার হলেই যথেষ্ট ছিল। বগোটার 'এল ডোরাডো' এয়ারপোর্টেও বাধ সাধল কলোম্বিয়ান ইমিগ্রেশন। মার্কিন পাসপোর্টটাকে বিভিন্ন কায়দায় ধর্ষন করা হল, পাসপোর্টের ছবির সাথে শতবার মেলানোর চেষ্টা করল আমার চেহারা। কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলতেই গিন্নী ইশারায় নিষেধ করল। আভ্যন্তরীন ফ্লাইটে এ ধরনের হাংগামা কলোম্বিয়ার মত দেশে আশা করিনি, তাই হজম করতে কষ্ট হল। ঝামেলা চুকিয়ে এভিয়াংকার ফ্লাইটে ঢুকতেই মনে হল আমিই ছিলাম শেষ যাত্রী এবং আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল বাকি সবাই। সব মিলিয়ে দেড় ঘন্টার ভ্রমন। ডান-বা আর এদিক ওদিক শেষে আকাশে ডানা মেলতেই ভুলে গেলাম এয়ারপোর্টের তিক্ততা।

Columbia

ড্রাগ রিলেটেড ইস্যুর কারণে দেশটায় প্রচুর সমস্যা, খুনাখুনীও হচ্ছে যত্রতত্র, বহিবিশ্ব হতেও আসছে প্রচন্ড চাপ। কিন্তূ বাইর হতে হঠাৎ করে দেশটায় ঢুকলে এর সামন্যতম রেশও চোখে পরবেনা। কলোম্বিয়াকে মনে হবে দক্ষিন আমেরিকার অন্য দশটা দেশের মতই ফুটবল আর নাচ-গান পাগল একটা দেশ হিসাবে। আকাশ হতে বগোটাকে দেখাল শিল্পীর নিপুন ছোয়ায় আঁকা ছবির মতন। উঁচু উঁচু দালান, পাশাপাশি এন্ডিসের সাড়ি সাড়ি চূঁড়া। পাহাড়ের কোল ঘেষে ঘোরাফেরা করছে খন্ড খন্ড মেঘ, কাব্য রসিকদের জন্যে এ হতে পারে সৃষ্টির অফুরন্ত খোড়াক । এসব দেখতে পৃথিবীর এ প্রান্তে বছর জুড়েই লেগে থাকে ট্যুরিষ্টদের অস্বাভাবিক ভীড়। প্রকৃতি ও মানুষের মিলনমেলার এই বিশাল ক্যানভাস হাতছানি দিয়ে ডাকে ভ্রমনপিপাসুদের।

ছোট বিমানটায় ট্যুরিষ্টদের সংখ্যা নেহাত কম মনে হলনা। স্প্যনিশ ভাষাভাষী লাতিনোদের দেশ হিসাবে আলাদা করাটা খুব সহজ নয়, কিন্তূ সাদা চামড়ার ইউরোপীয় আর রোদে পোড়া অষ্ট্রেলিয়ানদের চিনতে বিশেষ কোন অসূবিধা হয়না। ঘন মেরুন রংয়ের আটসাট পোশাকের এয়ারহোষ্টেসদের আতিথেয়তায়ও কোন ফাঁক ছিলনা। ট্যুরিজম্‌ পৃথিবীর এ প্রান্তের প্রাণ, এর উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে লাখ লাখ মানুষ, তাই এ শিল্পকে বাচিয়ে রাখার কলোম্বিয়ানদের প্রচেষ্টা চোখে পরবে জীবনের সর্বত্র। যাচ্ছি ক্যরাবিয়ান সমুদ্র পাড়ের শহর শান্তা মার্তায়। দেশটার উত্তরে মাগ্‌দ্যালেনা ডিপার্টমেন্টের এ শহরটাকে তিন দিক হতে ঘিরে রেখেছে Sierra Nevada de Santa Marta পাহাড়। নৌ চলাচলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শহরের নৌ বন্দর। ১৫২৫ সালে স্প্যনিশ দখলদার Rodrigo de Bastidas ভিত্তি স্থাপন পূর্বক ক্যাথলিক সেইন্ট মার্থার নামে নাম করণ করেন শহরটার। বলা হয় সান্তা মার্তা শহর কলোম্বিয়ার প্রথম দিকের শহরগুলোর অন্যতম শহর। এ শহরকে ঘিরে কলোম্বিয়ানদের গর্বের শেষ নেই।

Columbia

দেড় ঘন্টার পথ সোয়া ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আসতেই রক্ত হীম হয়ে গেল। পাহাড় ও সমুদ্রের ফাঁকে ছোট্ট একটা এয়ারষ্ট্রীপে এ ধরনের একটা বিমান কি করে ল্যান্ড করবে মাথায় ঢুকলনা। যাত্রীদের সবার চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছায়া। অনিশ্চয়তা এক ধরনের নীরবতা নিয়ে এল ফ্লাইটের ভেতর। যতই নীচে নামছি মনে হচ্ছে সমুদ্রের উপর ল্যান্ড করতে যাচ্ছি আমরা। যেদিকেই তাকাই শুধু ক্যরাবিয়ান সমুদ্রের নীল পানি আর রাশি রাশি ঢেউ, রানওয়েটা চোখে পরলানা কোথাও। ভ্রমন জীবনে এতবড় ভয় কোথাও পেয়েছি কিনা মনে করতে পারলামনা। গিন্নীকে দেখলাম চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন ঈশ্বরকে স্মরণ করতে। পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যে কায়দায় গোত্তা খেয়ে ঢিলটা ছুটে যায় একই ভাবে আমাদের প্লেনটাও আছড়ে পরল সরু রানওয়ের উপর। ভয়ে চীৎকার করে উঠল যাত্রীরা। সবকিছু শান্ত হতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। পাইলট তার খোঁয়াড় হতে বের হয়ে বত্রিশ দাঁত বের হাসি দিতেই তালিতে ফেটে পরল সবাই। মনে হল বিশ্বজয় হয়ে গেল এইমাত্র। ল্যান্ডিংয়ের এই সমস্যাটা নাকি প্রায়ই হয় শান্তা মার্তা এয়ারপোর্টে। রানওয়ে হতে প্লেন ছিটকে সাগরে ঠাঁই নিয়েছে এমন ঘটনাও নাকি কম নয়। এসব এখন অতীত, এ নিয়ে বেশী ভাবতে চাইলামনা।

Columbia

প্লেন হতে বের হয়ে এক কদম এগুতেই তাপদাহের তীব্র ধাক্কা এসে আছড়ে পরল চোখে মুখে। মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবীতে এমনটা হয়েছিল শেষবার, কিন্তূ পৃথিবীর এ প্রান্তে এমনটা হতে পারে জানা ছিলনা। ধাক্কার ধকল সইতে বেশ কিছুটা সময় ব্যায় হল। ছোট অথচ খুবই গোছগাছ একটা এয়ারপোর্ট। চেক-ইন লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট হতে বেরুতেই স্তব্দ হয়ে গেলাম। এ কোথায় আমরা? স্বর্গ বলে কিছু থাকলে শান্তা মার্তা নিশ্চয় সে স্বর্গের সাক্ষাৎ প্রতিচ্ছবি।
- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন