সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ একজন থেকে থাকলে কোনভাবেই সুবিচার করেননি বাকি এক কোটি স্বদেশীর সাথে (সংখ্যাটার বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই) যারা আমার সাথে ডিভি লটারির জন্য দরখাস্ত করেছিল। এমন একটা লটারি জেতা আমার জন্য জরুরি ছিলনা। স্কিল মাইগ্রেশনের সুবিধা নিয়ে আমি ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছি। চেষ্টা করছি মেইনষ্ট্রীম অস্ট্রেলিয়ার সাথে মিশে যেতে। সুশাসন ও আর্থ-সামাজিক নিশ্চয়তার বিচারে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান কোন অংশেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে কম ছিলনা। তাই লটারি জেতার প্রাথমিক উত্তেজনা থিতিয়ে আসার পর চিন্তায় পরে গেলাম নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। 'কেন আমি যুক্তরাষ্ট্রে যাব?' - প্রশ্নটা চাইলেও মগজ হতে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। কাছাকাছি এমন কেউ ছিলনা যার সাথে এ নিয়ে মতবিনিময় করা যেত। যার সাথে আলোচনা করা যেত সেই সজল এখন বাংলাদেশে। আমি জানি সজল সামনে থাকলে কসে একটা ধমক লাগাত এ নিয়ে দোটানার জন্য। অন্যদিকে এ ছিল এমন কিছুর হাতছানি যা এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিলনা। চাওয়া পাওয়ার অংক মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসলাম... অনেক হয়েছে পৃথিবীর এ প্রান্তে। এবার বেরিয়ে পরার পালা। কবিগুরুর কবিতার ভাষায় নিজকে বুঝালাম...সব ঠাঁই মোর ঘর আছে,আমি. সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। দেশে দেশে মোর দেশ আছে,আমি. সেই দেশ লব যুঝিয়া...
চাইলেই ঠাঁই পাওয়ার মত দেশ ছিলনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পেপার-ওয়ার্কের পাহাড় ছিল সামনে। মার পেট হতে বের হয়ে বাকি দিনগুলোর উপর একটা খেরো খাতা লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল। কোথায়? কবে? কেন? - এ সমীকরণ মেলাতে আমাকে ফিরে যেতে হয়েছিল ইউরোপের প্রায় বার বছরের জীবনে। লেখাপড়া, ব্যক্তিগত জীবন, চাওয়া-পাওয়া, কোনকিছুই লুকানোর সুযোগ ছিলনা। সকালে কাজে যাই, বিকেলে বাসায় ফিরে শুরু করি কাগজপত্র মেলানোর ম্যারাথন। প্রতিদিনই দেশে ফোন করি বিভিন্ন ডকুমেন্টের তাগাদা দিয়ে। আমার ভাল করেই জানা ছিল তথ্যসরবরাহে সামান্যতম গড়মিল হলে কলমের এক খোঁচায় সাঙ্গ হবে আমার অভিযান। অনাদিকাল ধরে বায় করার মত সময়ও হাতে ছিলনা। ওরা একটা সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। এর বাইরে যাওয়ার মানে ছিল গোটা প্রসেসটাকে বিদায় জানানো। ডকুমেন্টেশনের পাশাপাশি মেডিক্যাল চেকআপেরও একটা ফ্যাক্টর ছিল। সবকিছু গুছিয়ে নিতে প্রায় দুই মাসের মত সময় লেগে গেল। বসন্তের সুন্দর এক সকালে কাগজপত্র বগলদাবা করে মার্টিন প্যালেসের ৬৭ তলায় অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেটে হাজির হলাম।
তারিখ ও সময় ওরাই ঠিক করে দিয়েছিল। লম্বা লাইন দেখে হতাশ হলাম। গাইগুই করলাম অনেকক্ষণ। সময় কিছুতেই কাটছিলনা। পেটে অসম্ভব ক্ষুধা নিয়ে ঠায় বসে রইলাম। অবশেষে দুপুর একটার দিকে ডাক পড়ল। জমা দেয়া সব কাগজপত্র খুলে বসল আধা-সাদা, আধা-কালা টাইপের একজন মহিলা। অভিজ্ঞতা বলছিল এ নিশ্চয় ডমিনিকান আমেরিকানদে কেউ হবে। লিস্ট ধরে এগুচ্ছিলো এবং লাল কালির দাগ দিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছিল ডকুমেন্টের ওজন নিয়ে। এক জায়গায় এসে থেমে গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। দুঃখ প্রকাশ করে ভেতরে গেল এবং কিছুক্ষণ পর হাতে একটা বই নিয়ে আমার সামনে বসল। এবার কথা বলার পালা। সারমর্ম টেনে রায় ঘোষণা দিল, জমাকরা ডকুমেন্টে কোন ফাঁক ফোকর নেই। যা চাওয়া হয়েছে তা-ই দেয়া হয়েছে। শুধু একটা জিনিস ছাড়া...রুশ দেশের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। বইয়ের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, এটা ম্যান্ডেটরি, উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ভয়টা আগ হতেই কাজ করছিল। জানতাম প্রসঙ্গটা আসতে পারে। তবে অস্ট্রেলিয়াতে মাইগ্রেট করার সময় আমার সোভিয়েত অধ্যায় নিয়ে ঘাটাঘাটি না করায় একটা আশা ছিল। এবার কথা কাটছাঁট করে সোজা বলে দিল, রুশ ক্লিয়ারেন্স ছাড়া আমার ভিসা ইস্যু হবেনা। হাতে রুশ কনস্যুলেটের ঠিকানাটা ধরিয়ে আমাকে বিদায় জানালো। সময় দিল দেড় মাস।
মার্টিন প্যালেসের স্কাই স্ক্র্যাপর হতে বেরিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতদিনের পরিশ্রম শুধু একটা কাগজের জন্য বৃথা গেল। মনে মনে মার্কিন ভেঞ্চারের উপসংহার টেনে ওখানে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলাম। আমি জানতাম রুশ দেশের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আমি পেতে যাচ্ছিনা। কারণ যে ইন্সটিটিউটে লেখাপড়া করেছি সেটা আর নেই, তার নাম বদলে এখন অন্য এক ইউনিভার্সিটি। লেলিনগ্রাদ নামের যে শহরে বাস করেছি তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের দেশটাও এখন ভেঙ্গে জন্ম নিয়েছে পনেরটা দেশ। রুশদের একটা প্রবাদবাক্য আছে, ইয়েছলি মোখাম্মেদ নে ইদয়ত ক গোরে, ত গরা ইদয়ত ক মোখাম্মদু'...অর্থাৎ, যদি মোহম্মদ পাহাড়ের কাছে না যায়, পাহাড় চলে আসে মোহম্মদের কাছে...। আমার কাছে মনে হল রুশ দেশের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আসলে সেই পাহাড়, যা কোনদিন আমার কাছে আসবেনা।
- চলবে।