জীবন নদীর গল্প - পর্ব ৪

Submitted by WatchDog on Saturday, February 15, 2020

পৃথিবীর দেশে দেশে কতবার কতজনকে যে বিদায় জানিয়েছে চাইলেও আজ আর মনে করতে পারবনা। সেই ১৯৭৪ সাল হতে শুরু। চোখ আর নাকের পানি একাকার করে পুরানো বিমানবন্দর হতে যেদিন প্লেনে চড়েছিলাম আপনজনদের ফেলে যাওয়ার কষ্টের চাইতে বেশী কষ্ট পেয়েছিলাম অনিশ্চয়তার কথা ভেবে। কেন যাচ্ছি তা পরিষ্কার হলেও কোথায় যাচ্ছি তা ছিল ধোঁয়াটে। এক ডলার দেয়ার মত ক্ষমতা ছিলনা বাংলাদেশ ব্যাংকের। তাই খালি হাতেই রওয়ানা দিতে হয়েছিল পূর্ব ইউরোপের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে। দুই পর্বে প্রায় এগার বছর পর সেই সোভিয়েত ইউনিয়নকেও বিদায় জানাতে হয়েছিল বুকভরা কষ্ট নিয়ে। সেটা ছিল ১৯৮৭ সালের শরতের একটা রাত। সে রাতে প্রচণ্ড ঝড়ে ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল গোটা লন্ডন। পূর্ব লন্ডনের প্লেইসটো এলাকার ১০ তলা দালানের ৯ তলায় বসে সে রাতে ঘুমাতে পারিনি। প্রকৃতির এমন দানবীয় শক্তি এত কাছ হতে দেখতে হবে স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। ধ্বংস যজ্ঞের মাঝেই পরদিন বিদায় জানাতে হয়েছিল অনেকদিনের স্বপ্নের শহর লন্ডনকে। লিভারপুল স্ট্রীট রেলওয়ে ষ্টেশন হতে হারউইচ পোর্টেগামী ট্রেনটা চেপে বসতেই একরাশ কষ্ট এসে চোখ ঝাপসা করে দিয়েছিল। শুধু মনে-হয়েছিল পৃথিবীর এ প্রান্ত আর কোনদিন আসা হবেনা। দেখা হবেনা পিছু ফেলে যাওয়া বন্ধুদের। সামার জব করতে এসে সিলেটী ভাইদের রেস্টুরেন্টে কোনদিন আর ওয়েটিং করা হবেনা। পিছু ফেলতে হয়েছিল অনেক কথা, অনেক এডভেঞ্চার, অনেক অভিজ্ঞতা। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় পা রেখেছিলাম জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়ে দেয়ার স্বপ্ন নিয়ে। স্কিল মাইগ্রেশনের শেষ পর্ব এভাবেই ইতি টানার কথা-ছিল। তাসমান সাগর পারের নরম কাদামাটি শক্ত হওয়ার আগেই আবার বিদায়ের পালা। অনাড়ম্বর, অনানুষ্ঠানিক...নিভৃতে ছাড়তে হয়েছিল পৃথিবীর এ প্রান্ত। ছোট একটা সুটকেস নিয়ে সিডনীর কিংসফোর্ড এয়ারপোর্টে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই হাজির হয়েছিলাম লাউঞ্জে বসে জীবন নদীর একটা নতুন রূপরেখা আঁকাব বলে। ইমিগ্রেশন সেরে জাপান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ধরার উদ্দেশ্যে ভেতরে ঢুকতে খেয়াল হল কি যেন একটা মিসিং! হুঁশ হতেই কপালে হাত! দুলে উঠল আমার পৃথিবী!!! ডকুমেন্ট সহ হাতের ফাইলটা গায়েব!!!

মার্কিন কনস্যুলেট হতে স্থায়ী ভিসার কোন চিহ্নই পাসপোর্টে লাগানো হয়নি। ওরা একটা সীলকরা প্যাকেটে দিয়েছিল। কথা-ছিল প্যাকেটটা ওদেশে পৌঁছে ইমিগ্রেশনে দিলেই ওরা আমার পাসপোর্টে স্থায়ী ভিসার সিল লাগাবে। কি ঘটে গেল তা ঠাউর করতে বেশি সময় লাগলনা। লাগেজ চেকইন করার সময় হাতের প্যাকেটটা ট্রলির উপর দিকের চেম্বারে রেখে কাজটা সমাধা করেছিলাম। ভেতরে ঢুকার আগে ট্রলিকে ওখানেই বিদায় জানিয়েছিলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম আমেরিকা যাওয়ার তাবৎ ডকুমেন্ট সহ ফাইলটার কথা। দ্রুত ফিরে গেলাম ইমিগ্রেশনে। অস্থির হয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম কি ঘটে গেছে। ভদ্রলোক উত্তরে যা জানালেন তার সাথে দ্বিমত করার কোন অবকাশ ছিলনা। বৈধভাবে আমি এখন অস্ট্রেলিয়ার বাইরে। চাইলেই এপথ দিয়ে বেরোতে পারবোনা। আমি বুঝেও না বুঝার ভান করলাম। বুঝাতে চেষ্টা করলাম ঐ ফাইল ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করার কোন কারণ নেই আমার। অনেক কষ্টে বুঝাতে সক্ষম হলাম। একজন ইমিগ্রেশন পুলিশ সাথে দিয়ে আমাকে বের হওয়ার সীমিত অনুমতি দিল। পুলিশ সাথে নিয়ে প্রথমে গেলাম জাপান এয়ারলাইন্সের বুথে। ফেলে যাওয়া ট্রলির কোন চিহ্ন নেই ওখানে। হার্ট-বিট বেড়ে গেল। পুলিশই খুঁজে বের করল একজন ট্রলি-ম্যানকে। সে জানাল ফেলে যাওয়া ট্রলিটা বোধহয় ইতিমধ্যে ষ্টোরে চলে গেছে। পুলিশ তাড়া দিল, বলল ওখানেই চল। আমরা তিনজনই এলোপাথাড়ি দৌড়চ্ছি। অনেকে অবাক দেখছে আমাদের। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। এয়ারপোর্টের এক কোনায় বিশাল একটা ষ্টোর রুমে আমরা যখন হাজির হলাম এর বিশালতা দেখে আমি মুষড়ে পরলাম।

ট্রলির সমুদ্র হতে একটা নির্দিষ্ট ট্রলি খুঁজে পাওয়া সমুদ্রে সুঁই খোঁজার মতই মনে হল। সাথের পুলিশই তিনজনকে তিন লাইনে ভাগ করে দিয়ে খুঁজতে বলল। সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল। ফ্লাইটের সময়ও ঘনিয়ে আসছিল। বিশাল ষ্টোরটায় আমরা তিনজন তিন দিক হতে দৌড়চ্ছি আর কুকুর যেমন ড্রাগ সার্চ করে তেমনি আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি সাদা একটা ফাইল। এবং শেষ পর্যন্ত আমিই পেলাম আমার হারানো ফাইল। ট্রলির সমুদ্রে কোন এক কোনায় নীরবে শুয়ে ছিল স্বপ্নের ফাইল। ঘড়ির কাটায় ততক্ষণে ফ্লাইট ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। আবারও দৌড়। তবে এ যাত্রায় আর ততটা আশাহত ছিলাম না। আমি জানতাম ফ্লাইট মিস করলে নতুন একটা ফ্লাইট ধরা যাবে। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের দেখেই উৎফুল্ল হয়ে উঠল। চেহারা দেখেই বুঝতে পারল পেয়ে গেছি কাঙ্ক্ষিত বস্তু। কৃতজ্ঞতায় গলে মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেলাম আমি। আরও অবাক করে দিয়ে বলল, জাপান এয়ারলাইন্সের সাথে তাদের কথা হয়েছে, অন্তত আধাঘণ্টা দেরি করাতে রাজী হয়েছিল তারা। বাকি চেক-আপ মাফ করেদিল আমার জন্য। সোজা ফ্লাইটে উঠার আমন্ত্রণ জানালো। বগলের ফাইলটাকে ফসকে যাওয়ার দ্বিতীয় সুযোগ না দিয়ে আমি আবারও দৌড়াতে শুরু করলাম। আমার জন্যে অপেক্ষায় আছে প্রায় দুই শত যাত্রী। পরবর্তী গন্তব্য ওসাকা, জাপান।

- চলবে।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন